কুটু সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে বাথরুমে ঢুকল। আলাউদ্দিন স্নেহের স্বরে বললেন, কেমন আছি কুটু?
কুটু বলল, ভালো।
আলাউদ্দিন বললেন, জীবনে এই প্রথম বাথটাবে গোসল করছি, এর আগে কখনো করি নি। বিয়েটা আমার জন্য শুভ হয়েছে কী বলা কুটু?
অবশ্যই শুভ হয়েছে।
আজকের দিনটা নিয়ে খুবই দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। দিনটা কীভাবে কাটবে এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। দিনটা তো মনে হয় ভালোই কাটবে।
অবশ্যই ভালো কাটবে।
আগামীকালও ভালো কাটবে। জামিলা আগামীকালও আসবে না। আমাকে বলে গেছে।
এইটা তো স্যার সুসংবাদ।
আলাউদ্দিন গ্রামে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, শুধু সুসংবাদ বললে কম বলা হয়। এটা হচ্ছে মহা সুসংবাদ।
জ্বি স্যার, মহা সুসংবাদ।
নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বললাম এর জন্যে সামান্য খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছিল কি জানো? মনে হচ্ছিল, আমি যে কলেজের শিক্ষক,
জামিলা সেই কলেজেরই প্রিন্সিপ্যাল।
স্যার আপনি খুব দ্রুত খাইতেছেন। আস্তে আস্তে খাওয়ার নিয়ম।
পাইলট সাহেব কি আস্তে আস্তে খেতেন?
জি।
উনি ছিলেন পাইলট, আর আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান। উনার সঙ্গে আমাকে মিলালে তো হবে না। দুই জন দুই প্রান্তে।
তারপরেও আপনেদের মধ্যে মিল আছে।
এটা ঠিক বলেছ–আমাদের মধ্যে মিল আছে। উনি বাথটাবে শুয়ে থাকতেন। আমিও বাথটাবে শুয়ে আছি। উনি বাথটাবে শুয়ে জগ ভর্তি জিনিস খেতেন, আমিও বাথটাবে শুয়ে জগ ভর্তি জিনিস খাই। আমি উনার চেয়ে দ্রুত খাই। সামান্য একটু অমিল— তাই না?
জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিন আরেক গ্লাস নিলেন। লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, আরো মিল আছে উনার বাবুর্চির নাম ছিল কুটু মিয়া, আমার বাবুর্চির নামও কুটু মিয়া। ঠিক বলছি কি-না বল।
অবশ্যই ঠিক বলছেন।
শোন কুটু, আজ আমি বাথটাব থেকে উঠব না। এখানেই খাওয়া দাওয়া করব। অসুবিধা আছে?
কোনো অসুবিধা নাই স্যার।
তোমার পাইলট স্যার কি কখনো বাথটাবে শুয়ে খাওয়া দাওয়া করতেন? জ্বি করতেন। উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথটাবে থাকতেন। বই পড়তেন। কী বই পড়তেন? কী বই পড়তেন তা বলতে পারব না স্যার। আমি লেখাপড়া জানি না।
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি লেখাপড়া জানো না। তোমাকে একবার বলেছিলাম বাংলাবাজার থেকে অ আ বই কিনে আনব, ভুলে গেছি।
এই বয়সে আর লেখাপড়া শিখা কী হইব!
জ্ঞান অর্জনের কোনো বয়স নাই কুটু। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করা যায়। তুমি এখন যাও তো কুটু, খুঁজে পেতে দেখ এই বাড়িতে কোনো বই টই আছে কি না। থাকলে নিয়ে এসো। শুয়ে শুয়ে পাইলট সাহেবের মতো বই পড়ব।
বাংলা বই আনব না ইংরাজি বই আনব? একটা আনলেই হবে। হাতের কাছে যা পাও নিয়ে এসো।
কুটু কিছুক্ষণের মধ্যেই বই নিয়ে ফিরে এলো। ইংরেজি বই। বই- এর লেখকের নাম উইলিয়াম গোল্ডিং। বই-এর নাম লর্ড অব দা হাইস। আলাউদ্দিন বই পড়তে শুরু করলেন। প্রথম চ্যাপ্টারের নাম The sound of the shaell.
দশ মিনিটের মতো পড়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। লর্ড অব দ্যা ফ্লাইস কিছুক্ষণ বাথটাবের পানিতে ভেসে রইল। তারপর পানিতে ডুবে গেল।
ভনিতা করছ কেন
হাজী একরামুল্লাহ বললেন, মা আমি যে তোর মঙ্গল চাই এটা কি তুই জানিস?
হামিদা বলল, আসল কথাটা বলে ফেল মামা। ভনিতা করছ কেন?
হাজী সাহেব বললেন, আমি তোর মঙ্গল চাই এটাই আসল কথা।
হামিদা বলল, ঠিক আছে তুমি আমার মঙ্গল চাও। আমার প্রতি এই শুভকামনার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।
এ রকম ক্যাটক্যাট করে কথা বলছিস কেন মা? আয় আমরা সহজভাবে কিছুক্ষণ আলাপ করি। চিন্তায় তোর চোখ মুখ ছোট হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থায় থাকলে কিছুদিনের মধ্যে তোর সব চুল পেকে যাবে। তুই একটা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিস। আয় তোর সমস্যার সমাধান করি।
তুমি আমার সমস্যার সমাধান করবে?
আমি একা করব কীভাবে। তুই আমি আমরা দুজনে আলাপ করব। দরকার হলে আলাউদ্দিনকে ডাকব।
উনাকে ডাকবে কেন?
তোর সমস্যাটা তো তাকে নিয়েই। তাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে থাকছিস না।
হামিদা বলল, মামা আমি যে তোমার এখানে আছি তাতে কি তোমার অসুবিধা হচ্ছে? একটা বড় ঘর একা দখল করে আছি। অসুবিধা হবার কথা। যদি হয় খোলাখুলি বলে আমি চলে যাব।
কোথায় যাবি? নিজের বাসায় ফিরে যাবি?
না। মেয়েদের কোনো হোস্টেলে গিয়ে উঠব। চাকরিজীবী মহিলাদের জন্যে ঢাকা শহরে অনেক হোস্টেল তৈরি হয়েছে।
তোর নিজের বাড়িতে তুই যাবি না?
না। মামা তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? আমি এখন উঠ। আমার মাথা ধরেছে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকব।
হাজী সাহেব বললেন, আচ্ছা যা।
হামিদা বলল, শেষ কোনো কথা থাকলে বলতে পার।
হাজী সাহেব বললেন, এ রকম দুটফট করলে তো শেষ কথা বলতে পারব। শান্ত হয়ে সে। নে একটা পান খা।
মামা আমি পান খাই না।
খেয়ে দেখ ভালো লাগবে। মিষ্টি পান।
হামিদা বলল, পানটান কিছু খাব না। শেষ কথা কী বলতে চাচ্ছে বলো। আমি মন দিয়ে শুনছি।
হাজী সাহেব একটা পানি মুখে দিলেন। হামিদার পিঠে হাত রেখে নরম গলায় বললেন, আমি তার মঙ্গল চাই।
হামিদা অস্পষ্টভাবে হাসল।
হাজী সাহেব বললেন, তুই যদি আলাউদ্দিনের সঙ্গে বাস করতে না পারিস তাহলে বিয়ে ভেঙে দেয়া উচিত। বিয়ে তো কোনো খেলা না। সিরিয়াস ব্যাপার। যদি তুই ভাবিস বিয়েটা ভুল হয়ে গেছে, তাহলে সেই ভুল হজম করতে হবে কেন?
হামিদা ক্ষীণস্বরে বলল, তুমি এই লাইনে কথা বলবে আমি বুঝতে পারি নি। থ্যাংক য়ু।