জিলাপি এনেছেন কেন?
আলাউদ্দিন জবাব দিলেন না। কুটু মিয়া তাকে জিলাপি আনতে বলেছে বলে তিনি জিলাপি এনেছেন এটা বলতে ইচ্ছা করছে না। তার মন বলছে এই সত্যি কথাটা শুনলে হামিদা পছন্দ করবে না। নেসাস্তার হালুয়াও আনতে বলেছিল, হালুয়া খুঁজে পান নি।
হামিদা বলল, শুধু জিলাপি এনেছেন আর কিছু আনেন নি?
আলাউদ্দিন বলল, বেলি ফুল এনেছি।
বেলি ফুল এনেছেন?
জ্বি।
কই দেখি।
আলাউদ্দিন পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেলি ফুল বের করলেন। হামিদা বলল, বেলি ফুল, জিলাপি আপনি কি নিজ থেকে এনেছেন না কেউ আপনাকে আনতে বলেছে?
আলাউদ্দিন ব্রিত ভঙ্গিতে বললেন, নিজ থেকে এনেছি।
হামিদা বলল, জিলাপি আমি খাই না, আর বেলি আমার পছন্দের ফুল না। তারপরেও আপনাকে ধন্যবাদ।
আলাউদ্দিন পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করলেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি সিগারেট শেষ করেছেন। সেই সিগারেটের ধোঁয়া এখনো ঘরে আছে। এর মধ্যে আরেকটা সিগারেট ধরানো ঠিক হচ্ছে না। হামিদা নাক মুখ কুঁচকে আছে। যারা সিগারেট খায় না তারা সিগারেটের গন্ধ সহ্যই করতে পারে না। আলাউদ্দিন হামিদার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে সিগারেট ঠোঁটে নিলেন। ধরালেন না। কাজটা পরীক্ষামূলক। তিনি যদি দেখেন হামিদা রেগে যাচ্ছে তাহলে আর সিগারেট ধরাবেন না। আর যদি দেখেন সে রাগছে না তাহলে ধরাবেন। তিনি লাইটার হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। হামিদা বলল, আপনাকে কিছু জরুরি কথা বলা দরকার।
অত্যন্ত জরুরি।
জ্বি বলুন।
আজ আর বলব না। আমার শরীরটা খারাপ, মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলব বুঝতে পারছি না।
তাহলে আরেক দিন বলুন।
হ্যাঁ তাই করব। আমি এখন চলে যাব মামার কাছে। সেখানে কয়েক দিন থাকব। মনটা ঠিক করব।
আলাউদ্দিন অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, অবশ্যই অবশাই। মন ঠিক করা অত্যন্ত জরুরি। প্রয়োজনে দশ বার দিন থাকবেন। আমার ব্যাপারে কিছু চিন্তা করতে হবে না। সঙ্গে বাবুর্চি আছে। সে আবার অত্যন্ত দক্ষ।
আপনার বাবুর্চির বিষয়েও কিছু কথা আছে।
বলুন কী কথা। আপনার সঙ্গে বেয়াদবী করলে সেটাও বলুন। ওকে সাইজ করা দরকার আছে। প্রায়ই ভাবি সাইজ করব। শেষে সাইজ করা হয় না।
বাবুর্চির বিষয়ে যে কথাগুলি বলতে চাচ্ছি সেগুলিও আজ না বলে অন্যদিন বলব। অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনি সিগারেট ধরাচ্ছেন না। একবার ঠোঁটে নিচ্ছেন একবার হাতে নিচ্ছেন। সিগারেট ধরান।
আলাউদ্দিন আনন্দের সঙ্গে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনি কখন যাবেন?
হামিদ বলল, এখনই যাব।
হামিদার কথা শেষ হবার আগেই কুটু ঢুকল। তার হাতে চায়ের কাপ। হামিদা কুটুকে দেখে আবারো ধাক্কার মতো খেল। এই কুটু মিয়া আগের কুটু মিয়া না। অতি অল্প সময়ে সে চুল কেটে এসেছে। হাতের নখ কেটেছে। গোসল করে ইস্ত্রি করা সার্ট প্যান্ট পরেছে। নোংরা ভাব তার শরীরে এখন একেবারেই নেই। তার গা থেকে লেবুর হালকা সুবাস আসছে। লেবুর গন্ধ হামিদার খুবই পছন্দ।
কুটু হামিদার দিকে তাকিয়ে বলল, আপা আপনের জন্য চা আনছি।
হামিদা বলল, আমি তো তোমার কাছে চা চাই নি।
কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটু খাইয়া দেখেন আপা। আপনের ভালো লাগব। এইটা মশলা আছে। ঘন কইরা দুধ চা বানাইয়া তার মধ্যে গরম মশলা দেওয়া হয়। নেপালীরা এই চা খুব পছন্দ করে। একটা চুমুক দেন।
হামিদা খুব অনাগ্রহের সঙ্গে চায়ে চুমুক দিল। শান্ত গলায় বলল, আমি চা খাচ্ছি। এখন দাঁড়িয়ে থেকো না। সামনে থেকে যাও।
কুটু বলল, চা-টা কি আপনার মন মতো হইছে আপা?
হামিদা বলল, চা ভালো হয়েছে।
কুটু বলল, শুকরিয়া।
বলেই সে সরে গেল। আলাউদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, জামিলা শোন— কুটু অসাধারণ এক প্রতিভা।
হামিদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আপনি আমাকে কী নামে ডাকলেন?
আলাউদ্দিন গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, জামিলা বলেছি। দয়া করে রাগ করবেন না। আর বলব না।
জামিলা বলেছেন কেন? আমার নাম হামিদা, জামিল না।
জ্বি আমি জানি। হামিদ স্যার আমাদের অংক করাতেন। উনাকে খুবই ভয় পেতাম। হামিদা নামটা শুনলেই স্যারের কথা মনে হয়। এই জন্যই আপনাকে দামিলা বলেছি। আর বলব না। তবে জামিলা নামের অর্থ ভালো। জামিলা নামের অর্থ সুন্দরী।
হামিদা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি এখন চলে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে। পরে কথা বলব। দু তিন দিন পরে যে-কোনো এক সময় কথা হবে।
আলাউদ্দিন বলেন, জ্বি আচ্ছা।
আমার কাজের মেয়েটিকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার বাবুর্চি আছে। আপনার অসুবিধা হবার কথা না।
কোনো অসুবিধা হবে না। আমাকে নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
হামিদা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি আপনাকে নিয়ে চিন্তা করছি না। আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করছি। আচ্ছা আমি এখন যাচ্ছি।
আলাউদ্দিন বাথটাবের পানিতে শুয়ে আছেন। তার মাথাটা শুধু ভেসে আছে। পুরো শরীর পানির নিচে। বাথটাব ভর্তি ফেনা। আলাউদ্দিনের মনে হচ্ছে এরচে সুন্দর সময় তিনি তাঁর জীবনে পার করেন নি। হামিদার বাড়িতে বাথটাব আছে এটাই তিনি কল্পনা করেন নি। বাথটাবে নামার সময় শুরুতে তার একটু ঠাণ্ডা লাগছিল। এখন আর লাগছে না। এখন মনে হচ্ছে পানির তাপমাত্রা এরচে বেশি হলে ভালো। লাগত না।
তিনি একাই আছেন। কুটু আশেপাশে নেই। একটু আগে হাতের কাছে একটা ট্রে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ট্রেতে একটা জপ এবং একটা গ্লাস। জগে যে বস্তু আছে তার রঙ টমেটো জুসের লাল রঙ না, হালকা সোনালি রঙ। এটা নিশ্চয়ই অন্য কোনো জিনিস। যে জিনিসই হোক, অমৃতসম। এই জিনিস এক জগ খেলে তৃষ্ণা মিটবে না। এই জিনিস খেতে হবে এক বালতি। আলাউদ্দিন সিগারেট ধরালেন। পানিতে ভিজতে ভিজতে সিগারেট টানার একটাই সমস্যা। সিগারেট ভিজে যায়। পানিতে সিগারেট খাবার জন্য অন্যরকম সিগারেট থাকার দরকার ছিল। যে সিগারেট পার্টিতে ভিজবে না। কুটুাকে বললো একটা ব্যবস্থা সে নিশ্চয়ই করবে। অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মানুষ। দরিদ্র দেশে পড়ে আছে বলে তার প্রতিভার কদর হলো না। কটু ইউরোপ আমেরিকায় জন্মালে তাকে নিয়ে। কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। আলাউদ্দিন ডাকলেন, কুটু! কুটু কোথায়?