কুটু আজ সকালে তার বিছানাপত্র নিয়ে হামিদা বানুর বাড়িতে উঠেছে। আলাউদ্দিন সঙ্গে ছিলেন। তিনি কিছু কেনাকাটার জন্যে নিউ মার্কেটে গেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে আসার প্রস্তুতি হিসেবে এইসব কেনাকাটা। কুটু বলে দিয়েছে কী কী লাগবে। কেনাকাটার লিস্টে আছে—
স্পঞ্জের স্যান্ডেল
গেঞ্জি
পায়জামা-পাঞ্জাবি
রুমাল
তোয়ালে
টুথপেস্ট
টুথব্রাশ…
রুমাল ছাড়া লিস্টের সব জিনিসই আলাউদ্দিনের আছে। তারপরেও কুটু বলে দিয়েছে এই জিনিসগুলি নতুন হলে ভালো হয়। কেন ভালো হয় আলাউদ্দিন জিজ্ঞেস করেন নি। কুটুর বিবেচনার উপর তার গভীর আস্থা।
ব্যবহারের জিনিসপত্র ছাড়া অন্য কিছু জিনিসের লিস্টও কুটু করে দিয়েছে— তার মধ্যে আছুে পনেরোটা বেলি ফুল, এক কেজি গরম জিলাপি, আধা কেজি নেসাস্তার হালুয়া। এই জিনিসগুলি হামিদা বানুর জন্যে এবং আনতেই হবে। এর ভেতরেও কুটুর হয়তো কোনো বিবেচনা আছে।
স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে আসার ব্যাপারে আলাউদ্দিন সাহেবের গভীর শংকা ছিল। অভ্যস্থ জীবন যাপনের বাইরে কিছু করার অর্থই ভীতি। কুটু এই ভীতি দূর করেছে। কুটুর কথাবার্তায় তিনি ভরসা পেয়েছেন। তবে একা একা টিভি দেখা, চ্যানেল বদলাতে বদলাতে ইয়ে মেশানো টমেটো জুস খাওয়া কীভাবে হবে তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। কুটু বলেছে, মানুষ যেমন চায় তার দুনিয়া তেমন হয়। আপনের চিন্তার কিছু নাই। কুটুর কথার অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হয় নি, তবু তিনি। ভরসা পেয়েছেন। কারণ কুটু ভরসা দিয়ে কথা বলেছে। সান্ত্বনার কথা বলে নি।
কুটু এখন দাঁড়িয়ে আছে হামিদা বানুর বসার ঘরের মাঝখানে। হামিদা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। হামিদার ভুরু কুঁচকে আছে। যে সব মেয়ে শুয়োপোকা ভয় পায় তাদের সামনে বিশাল আকৃতির শুয়োপোকা দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের মুখের ভাব যেমন হয় হামিদার মুখের ভাব ঠিক সে-রকম।
কী ব্যাপার, তোমাকে প্রশ্ন করছি তুমি জবাব দিচ্ছ না কেন? তোমার নাম কুটু?
জ্বি আপা।
প্রথমবার যখন প্রশ্ন করলাম তখনই তো জবাব দিতে পারতে। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতে হলো কেন?
কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমার নাম তো আপা জানেন। জাইনাও জিজ্ঞাস করছেন এই জন্যে চুপ কইরাছিলাম।
ভবিষ্যতে কিছু জিজ্ঞেস করলে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেবে। চুপ করে থাকবে না।
জি আচ্ছা।
তুমি কি জানো তোমার মতো নোংরা মানুষ আমি আমার দীর্ঘ জীবনে দেখি নি? তোমার গা থেকে পচা গন্ধ আসছে— এটা তুমি জানো?
কুটু জবাব দিল না। হামিদার রাগ ক্রমেই বাড়ছে। সে রাগটা সামলাবার চেষ্টা করছে। সামলাতে পারছে না। আজকের দিনে সে রাগতে চায় না।
তুমি তো হাতের নখও কাট না। নখ বড় হয়ে পাখির নখের মত বেঁকে গেছে। হাতের নখ কাট না কেন?
একটু অসুবিধা আইে আপা।
বলো কী অসুবিধা।
আমার নখ শক্ত, ব্লেড দিয়া কাটে না। সারাদিন পানিতে ডুবাইয়া রাইখা নখ। নরম কইরা কাটতে হয়।
তোমার মাথার চুলও কি শক্ত? লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত চলে এসেছে। আমি নিশ্চিত তোমার মাথা ভর্তি উকুন। তুমি যখন রান্না করতে লাসা তোমার মাথার উকুন এসে হাঁড়িতে পড়ে। বলো মাথার চুল কাট না কেন?
আমার মাথার তালুতেওঁ অসুখ আছে আপা। চুলে টান পড়লে ব্যথা লাগে।
হামিদা কঠিন গলায় বলল, তোমাকে আমি এই বাড়িতে রাখ না। অবশ্যই না। আমার রান্নাঘরের ত্রি-সীমানায় তোমার মতো কেউ ঘুরঘুর করছে ভাবতেই যেনা লাগছে। তুমি চলে যাও।
চইলা যাব?
অবশ্যই চলে যাবে। তোমার বেন যদি কিছু পাওনা থাকে, উনার কাছ থেকে এসে নিয়ে যাবে।
এখন চইলা যা আপা।
হ্যাঁ এখন চলে যাবে। পাঁচ মিনিটের মাথায় বিদায় হবে।
কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আপা একটা ছোট্ট কথা… যদি অনুমতি দেন বলি।
বলো। সংক্ষেপে বলো।
স্যারের সঙ্গে যদি দেখা না কইরা চইলা যাই স্যরি মনে খুব কষ্ট পাইবেন। উনি আমার স্নেহ করেন। স্যারের মানে মায়া মমতা বেশি।
মায়া মমতা যে বেশি তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মায়া মমতা বেশি না হলে তোমার মতো কোনো জিনিসকে ঘরে রাখতে পারে না। তোমাকে ঘরে মানায় না। তোমাকে ম্যানহোলের নিচে মানায়।
কুটু প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, স্যারের খুব শখ ছিল আমার হাতের একটা রান্না আপনেরে খাওয়াইবেন। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল।
তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শেফ হলেও আমি তোমার হাতের রান্না খাব না। আমার ঘেন্না খুব বেশি।
গোসল কইরা পরিষ্কার হইয়া নিব। নাপিতের কাছে গিয়া চুল কাটব। কাঠমিস্ত্রির কাছে গেলে ওরা নখ কাইটা দিব। ওদের কাছে যন্ত্রপাতি আছে।
ওরা করাত দিয়ে তোমার নখ কাটবে?
জ্বি।
আমি আমার জীবনে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কথাবার্তা শুনেছি, তোমার মতো অদ্ভুত কথা শুনি নি। আমার সামনে থেকে যাও।
জ্বি আচ্ছা।
এখনই তোমাকে বিদায় হতে হবে না। তোমার স্যার আসুক। তার কাছে বিদায় নিয়ে তারপর যাবে।
চুলটা কাটায়ে আসব আপা?
হামিদা জবাব দিল না। সোফা থেকে উঠে চলে গেল। তার মন প্রচণ্ড খারাপ। মন খারাপটা এই পর্যায়ে গিয়েছে যে এখন শরীর খারাপ লাগছে। বিয়েতে রাজি হওয়াটা ভুল হয়েছিল এটা সে জানত। সেই ভুল যে এত বড় ভুল তা জানত না। আলাউদ্দিন নামের অজানা অচেনা লোক চলে এসেছে। হামিদা যে খাটে দীর্ঘ। জীবন একা শুয়েছে, সেই খাটের একটা অংশ দখল করে এই লোকটা পড়ে। থাকবে। সবচে বড় কথা তার দুই মেয়ের বাবার স্মৃতি এই খাটের সঙ্গে জড়িত। সে এবং শহীদ দুজনে মিলে গুলশানের কাঠের দোকান থেকে খাট কিনে এনেছিল। আর যাই হোক তাদের দুজনের খাটে বাইরের একজন মানুষকে শোয়ানো যায় না। হামিদার নিজেকে প্রসটিটিউটের মতো লাগছে। যে মেয়ে একেকবার একেকজনের সঙ্গে বিছানায় যায় সে প্রসটিটিউট ছাড়া আর কী। হামিদার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কান্না আসছে না। সে দরজা ভেজিয়ে নিজের ঘরের খাটে শুয়ে