আলাপ করার মতো আমার কেউ নাই।
আলাপ করার কেউ না থাকলে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে চাকর বাকরের সঙ্গে কেউ আলাপ করে? নাও, পান খাও।
আলাউদ্দিন আগ্রহের সঙ্গে পান মুখে দিলেন। মনে মনে দোয়া ইউনুস তিনি এখনো পড়ছেন। দোয়ায় মনে হয় একশন শুরু হয়েছে। হাজী সাহেব পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গে যাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে পাণ্ডুলিপির চেয়ে তিনি তার ভাগ্নি হামিদা বানুর বিবাহ নিয়ে বেশি উৰ্ঘিশ্ন।
হাজী সাহেব খানিকটা কুঁকে এসে বললেন, তুমি তাহলে বিবাহের ব্যাপারে পজেটিভ সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
জ্বি।
তাহলে তো হামিদাকে রাজি করানো দরকার। রাজি কেন করানো দরকার এটা শোন। পাড়ার মাস্তানদের গডফাদার টাইপ এক লোকের চোখ পড়েছে হামিদার দিকে। বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। নানান ভাবে যন্ত্রণা করছে। অতি বদ লোক। অতি হারামজাদা। থাকে মদের উপর। গুণ্ডাপাত্তা পুষ। স্ত্রী মারা গেছে–আবার বিবাহ করবে। এর কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া আর মেয়ের গলায় দড়ি দিয়ে নিজের হাতে তেতুল গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া একই কথা। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
তুমি বুঝতে পারছ না। এই জাতীয় বদলি যে মানুষের উপর কী পরিমাণ জুলুম করতে পারে তোমার কোনো ধারণাই নেই। হামিদার রূপে পাগল হয়ে সে যে হামিদাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে তা কিন্তু না। হামিদাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। বাড়িটার জন্যে।
বাড়িটার জন্যে মানে?
হামিদার যে বাড়িতে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেটা হামিদার নিজের বাড়ি। তার স্বামী বানিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। ঢাকা শহরে পাঁচ কাঠা জমির উপর দোতলা বাড়ি সহজ ব্যাপার তো না। যে কটা পাত্র হামিদাকে বিয়ে করার আগ্রহ দেখিয়েছে সবার নজর বাড়িটার দিকে। এর মধ্যে একজন আবার বাড়ির দলিল দেখতে চেয়েছিল। বুঝ অবস্থা। একমাত্র তোমাকে দেখলাম এই ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নাই।
আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। তিনি এখনো দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারছেন না। হাজী সাহেব যদি ফস করে বলে বসেন— পাণ্ডুলিপিটা কোথায়? বের কর দেখি কয় ফর্মা হয়েছে। তাহলে কী হবে?
আলাউদ্দিন জ্বি।
তুমি লোক ভালো। আমার ভাগ্নির জন্যে একজন ভালো মানুষ দরকার। আর কোনো কিছুরই দরকার নাই। তুমি যদি সত্যি সত্যি বিয়েতে রাজি থাক তাহলে আমি আমার ভাগ্নিকে রাজি করাব। কী বলো তুমি? তোমার মন ঠিক আছে তো?
আলাউদ্দিন ক্ষীণ স্বরে বললেন, জ্বি।
এই বয়সের বিয়েতে তো আর প্যান্ডেল বানানো হবে না। তুমিও পাগড়ি পরে ঘােড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাবে না। কাজীকে ডেকে আনব। তিনবার কবুল বলা হবে— মামলা ডিসমিস। না-কি উৎসব করতে চাও?
জ্বি না।
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও তো তোমার যোগাযোগ নাই।
জ্বি না।
তাহলে আর কী? কাজী ডেকে ঝামেলা মিটিয়ে দেই। বিয়ের পরে না হয় কিছু লোকজন ডেকে চাইনিজ হোটেলে রিসিপসনের মতো করলে। কী বলে?
আলাউদ্দিন ক্ষীণ স্বরে বললেন, আপনি যা ভালো মনে করেন।
বিয়ে করবে তুমি, আমার ভালো মনে করাকরির তো কিছু নাই। এখনো সময় আছে। হ্যাঁ না ভেবে বলো। তুমি হ্যাঁ বললে আমি হামিদার কাছে চলে যাব। যেভাবে হোক তাকে রাজি করাব। বিয়েতে রাজি না হলে লোকমান ফকিরের খপ্পর থেকে তাকে উদ্ধার করার মাত্র ক্ষমতা আমার নাই।
লোকমান কির কে?
ঐ হারামজাদার কথা একটু আগে না বললাম? গুণ্ডাপাণ্ডা পুষে। ওয়ার্ড কমিশনার। মদ খেয়ে একদিন রাস্তার উপর পড়েছিল। যে-ই পাশ দিয়ে যায় হামাগুঁড়ি দিয়ে তার পায়ে ধরতে যায়।
জ্বি বুঝতে পেরেছি।
এখন তুমি বলো— হামিদাকে রাজি করাব?
জি আচ্ছা।
তাহলে তুমি আর দোকান থেকে বের হয়ো না। খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম। নাও। সব যদি ঠিকঠাক মতো হয় আমি কাঙ্খী ডেকে এনে আমার বাড়িতে বিয়ে পড়িয়ে দেব। এক জিনিস নিয়ে দিনের পর দিন আর কত ঘটঘট করব? ঠিক আছে?
জ্বি।
এত শুকনা গলায় জ্বি বলছ কেন? জোর করে ধরে বেন্ধে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি এরকম মনে করছ না তো?
জি না।
ভেরি গুড। দাও আরেকটা সিগারেট দাও। সিগারেটের ধোয়া দিয়ে মাথা খোলাসা করে কাজে নেমে পড়ি।
আলাউদ্দিন দোয়া ইউনুস পড়া বন্ধ করলেন। দোয়া কাজ করেছে। হাজী সাহেব হস্তরেখা বিজ্ঞান বই-এর পাণ্ডুলিপি বিষয়ে কোনো কথা না বলেই উঠে পড়েছেন। তিনি যে বস্তুর সঙ্গে বের হয়েছেন তাতে মনে হয় না আজ আর পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গ উঠবে।
আলাউদ্দিনের দুপুরের খাওয়াটা ভালো হলো না। কুটুর হাতের রান্না খেয়ে এমন হয়েছে অন্য কোনো কিছুই আর মুখে স্কুচে না। দুপুরে তিনি লম্বা ঘুম দিলেন। ঘুম ভাঙ্গল বিকেলে। হাজী সাহেবের দােকানের ম্যানেজার বলল, আপনাকে থাকতে বলেছেন। আপনার জন্যে জরুরি খবর আছে।
আলাউদ্দিন বললেন, কী খবর?
ম্যানেজার বলল, কী খবর তা তো জানি না। চা নাশতা কী খাবেন বলেন। গোশত পরোটা আনাই।
আনাও।
ভরপেট গোশত পরোটা এবং দুকাপ চা খেয়ে আলাউদ্দিন আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যার পর। তিনি হয়তো আরো কিছুক্ষণ ঘুমাতেন, হাজী সাহেব নিজে গা ঝাকিয়ে ডেকে তুললেন। হাসি মুখে বললেন, আজই তোমার বিয়ে।
হাজী সাহেব আলাউদ্দিনের জন্যে নতুন পায়জামা পাঞ্জাবি কিনে এনেছেন। তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, তাড়াতাড়ি একটা সেলুন থেকে চুল কেটে আল। সাবান ডলা দিয়ে গোসল কর। পানির ব্যবস্থা দোকানেই করেছি।
আলাউদ্দিন কোনো কিছু না বুঝেই বললেন, জি আচ্ছা।