মেয়ে কী করেছে?
জানি না স্যার।
মেয়েটা কে?
গার্মেন্টসের এক মেয়ে। সাইফুল্লাহ সাহেবের এখানে একেক সময় একেক মেয়ে থাকে। নানান ভ্যাজাল।
ভ্যাজাল তো বটেই।
উনার যে অবস্থা দেখলাম স্যার, নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়তেছে। কাউরে চিনতে পারে না। বাঁচে কি-না সন্দেহ।
দেখতে গিয়েছিলে?
জ্বি না। সিঁড়ি দিয়া নামানির সময় দেখলাম। মন খারাপ হইয়া গেল। কে জানে কী বৃত্তান্ত।
মন খারাপ হবার কথা। হাজার হোক প্রতিবেশী।
স্যার, চা আরেক কাপ দিব?
আলাউদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দাও। তিনি মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। নাশতা খেয়েই আজ বাংলাবাজার চলে যাবেন।
বালিশটা আরেকবার দেখতে ইচ্ছা করছে। কাল রাতে মনে হয়েছিল রক্ত লেগে আছে। এখনও কি তাই? রক্ত শুকিয়ে হয় কালো। কালো কোনো দাগ কি বালিশে আছে। আলাউদ্দিন দুটা বালিশই উল্টে পাল্টে দেখলেন। কোনো দাগ নেই। তিনি অনিন্দিত গলায় ডাকলেন, মাই ডিয়ার কুটু! আরেক কাপ চা দাও।
চোখ পিটপিট করতে লাগলেন
হাজী একরামুল্লাহ বললেন, তোমার কী হয়েছে?
আলাউদ্দিন জবাব না দিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগলেন। হাজী সাহেব বললেন, চোখ পিটপিট করছ কেন?
আলাউদ্দিন বললেন, রোদটা কড়া। চোখে লাগছে।
হাজী সাহেব বললেন, ঘরের ভেতরে রোদ কোথায়? চোখ পিটপিটানি বন্ধ করে বলো তো তোমার ঘটনা কী?
আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। বলার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি। দিনের পর দিন তিনি নিজের শোবার ঘরের খাটের ওপর ছিলেন। নদিন পর আজ প্রথম বাইরে এসেছেন। আলো চোখে লাগছে। দোকানের ভেতর রোদ নেই ঠিকই, কিন্তু বাইরে ভাদ্র মাসের রোদ ঝলমল করছে। রোদের দিকে তাকালেই চোখ জ্বালা করে।
হাজী সাহেব বললেন, তোমার শরীরে পানি এসেছে না-কি? হাত-পা-মুখ ফোলা ফোলা। সমস্ত শরীরে গোল ভাব চলে এসেছে। সারাদিন কী কর? ঘুমাও?
আলাউদ্দিন সিগারেট ধরালেন। হাজী সাহেব বললেন, সিগারেট খাচ্ছি কারখানার চিমনির মতো। দশ মিনিটও হয় নি এসেছু, এর মধ্যে চারটা সিগারেট খেয়ে ফেললে।
আলাউদ্দিন চুপ করেই আছেন। হাজী সাহেবের সিগারেটের হিসেবে ভুল হয়েছে। সিগারেট চারটা খাওয়া হয় নি, তিনটা খাওয়া হয়েছে। এই নিয়ে তর্ক শুরু করা যায় না। হাজী সাহেব রেগে আছেন। ব্লগের মুহূর্তে তর্ক চলে না।
হস্তরেখা বই-এর পাণ্ডুলিপি কোথায়? এনেছ?
আলাউদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, এনেছি।
শেষ করেছ?
জ্বি।
কই দেখি।
একটু পরে দেই। বুঝিয়ে দিতে হবে।
হাজী সাহেবের রাগী মুখ সহজ হয়ে এলো। আলাউদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এই স্বস্তি সাময়িক, কারণ তিনি হস্তরেখা বিজ্ঞান বই-এর পাণ্ডুলিপি আনেন নি। যে বই লেখাই হয় নি তার পাণ্ডুলিপি অনবে কীভাবে? শিররের চ্যাপ্টারটা মাত্র শুরু হয়েছিল। পাণ্ডুলিপি না এনেও বলা হয়েছে এনেছি। এই মিথ্যা শেষ পর্যন্ত কীভাবে সামাল দিবেন কে জানে। আলাউদ্দিনের বুকের ভেতর ধুক বুক শব্দ হতে লাগল। ভালো ঝামেলায় পড়া গেল।
হাজী সাহেব সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, দেখি তোমার একটা সিগারেট খেয়ে দেখি।
আলাউদ্দিন সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিলেন। হাজী সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার আসার কথা ছিল বুধবারে। তুমি যখন বুধবারে এলে না, বৃহস্পতিবার চলে গেল, শুক্রবার চলে গেল তারপরেও তোমার খোঁজ নেই তখন একবার মনে হয়েছিল বই নিয়ে ব্যস্ত। বই শেষ না করে আসবে না। আমি ম্যানেজারকে সে-রকমই বলেছি। চা খাবে?
জ্বি না।
জি না আবার কী!চা খাও। মালাই চা।
জ্বি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন মনে মনে দোয়া ইউনুল পড়ছেন। এই দোয়া পড়লে যে-কোনো বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। আলাউদ্দিন ঠিক করলেন পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গ আবার না আসা পর্যন্ত তিনি এই দোয়া পড়তেই থাকবেন। এমন হওয়া বিচিত্র না। যে দেখা যাবে দোয়া ইউনুস পড়ার কারণে হাজী সাহেব পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গটা তুলতে ভুলে যাবেন। অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। এমন একটা ঘটনা টানো আল্লাহর জন্যে কোনো ব্যাপারই না।
চা চলে এসেছে। চা এবং পিরিচ ভর্তি জর্দা দেয়া পান। হাজী সাহেব অতি দ্রুত কয়েকটা চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মুখ ভর্তি করে পান নিলেন। পান চিবাতে চিবাতে সহজ গলায় বললেন, আমার ভাগ্নি হামিদাকে বিবাহের কথা নিয়ে কিছু ভেবেছ? ইচ্ছা না থাকলে না বলে দাও। কোনো অসুবিধা নেই। হামিদাও বেঁকে বসেছে। শুরুতে হ্যাঁ বলেছিল, এখন না বলছে। মেয়েদের এই সমস্যা। স্থিরতা বলে কিছু নেই। সাগরের ঢেউ— এই আছে এই নাই। তোমার নিজেরও তো বিয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহ আছে। ঠিক না। এই বয়সে সংসারের ঝামেলায় যেতে ইচ্ছা না করারই কথা।
আলাউদ্দিন বললেন, আমি বিবাহ করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তবে উনার মত না থাকলে তো কিছু করার নাই। সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। উনার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতা ও কালে না। আমরা তুচ্ছ।
হাজী সাহেব বললেন, তুমি বিবাহ করতে চাও?
আলাউদ্দিন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। মেয়ে যেখানে বেঁকে বসেছে সেখানে হ্যাঁ বলতে বাধা নাই। তিনি যতই হ্যাঁ বলুন বিয়ে তো হবে না।
ভালো মতো ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে?
জি।
তোমার কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলেছ?
জি না। তবে কুটুকে বলেছি।
কুটুকে বলেছ। কুটু কে?
আমার বাবুর্চি।
আরে রাখ তোমার বাবুর্চি। বাবুর্চির সঙ্গে কেউ নিজের বিয়ে নিয়ে আলাপ করে না-কি?