আলাউদ্দিন টিভির দিকে তাকালেন। টিভি খোলা আছে। নাটকের মতো কী যেন হচ্ছে। মারামারির দৃশ্য। ঘটনা কি এ রকম যে টিভিতে মারামারি হচ্ছে, কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে শব্দটা আসছে খাটের নিচ থেকে। এটাই তো যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু ঘরে এত ধোয়া কেন? আলাউদ্দিন ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন, কুটু মিয়া!
খাটের নিচ থেকে কেউ একজন ভারী শ্লেষ্মা জড়িত গলায় বলল, জি স্যার।
গলাটা কার? কুটু মিয়ার গলা? সে খাটের নিচে কী করছে? কাকে সে চেপে ধরেছে। আলাউদ্দিন আবারো কাপা কাঁপা গলায় বললেন— কুটু মিয়া?
জ্বি।
খাটের নিচে কী করছ?
কুটু জবাব দিল না। খাটের নিচের হুটোপুটি অনেক বাড়ল। এখন গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। আলাউদ্দিন বললেন, কী হচ্ছে ওখানে?
কুটু চাপা গলায় বলল, বালিশ দেন। স্যার, তাড়াতাড়ি একটা বালিশ দেন।
কী দিব?
বালিশ।
বালিশ দিয়ে কী হবে? হারামজাদার মুখের উপর বালিশ চাইপা ধরব।
কার মুখের উপর বালিশ চেপে ধরবে?
কটু জবাব দিল না। আলাউদ্দিন হতভম্ব হয়ে দেখলেন খাটের নিচ থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছে। ময়লা নোংৱা হাত। বড় বড় নখ। পাখির নখের মতো বেঁকে গেছে। হাতটা কেন আসছে? তাকে ধরার জন্যে? আলাউদ্দিন ভয়ে শিটিয়ে গেলেন।
বালিশ দেন।
আলাউদ্দিন একটা বালিশ কুটুর হাতের দিকে এগিয়ে দিলেন। খাটের নিচ থেকে আঁ আঁ শব্দ হচ্ছে। বালিশে চাপা দিয়ে কাউকে কি মারা হচ্ছে? কোনো একটা সূরা পড়া উচিত। কোনো সূরা মনে আসছে না। তিনি কি দুঃস্বপ্ন দেখছেন? হ্যাঁ এটাই হবে। দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু না। স্বপ্নটা ভেঙে গেলেই দেখবেন সব স্বাভাবিক আছে। তখন তিনি কুটুকে ডেকে চা দিতে বলবেন। চা খাওয়ার আগে গোসল করা দরকার। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। স্বপ্নটা কখন ভাবে? চিৎকার করে কুটকে ডাকলে কি ঘুম ভাঙলে? আলাউদ্দিন ফুসফুস ফাটিয়ে চিক্কার করলেন— কুটু! কুটু! গলা দিয়ে ফ্যাস ফ্যাস জাতীয় আওয়াজ হলো। এই স্বপ্ন মনে হয় ভাবে না। স্বপ্ন চলতেই থাকবে। মেয়েলি গলায় কে যেন কাঁদছে। দেয়ালে শব্দ হচ্ছে। সাইফুল্লাহলের বাড়িতে কি? না-কি এটা স্বপ্ন। আলাউদ্দিন ক্লান্ত হতভম্ব গলায় ডাকলেন, কুটু।
তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বসার ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। থপথপ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কুটু আসছে।
কুটু! কুটু তুমি কোথায়?
দরজা ঠেলে কুটু ঢুকল।
আলাউদ্দিন ধরা গলায় বললেন, বাতি জ্বালাও।
কুটু বাতি জ্বালাল। আলাউদ্দিন বললেন, দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
কুটু বলল, চা খাইবেন স্যার?
আলাউদ্দিন বলেন, চা খাব।
চা আনতেছি।
আলাউদ্দিন বললেন, তুমি কি কোনো চিৎকার, হুটোপুটির শব্দ শুনেছ?
কুটু বলল, জ্বি না।
আলাউদ্দিন বললেন, শোনার কথাও না। স্বপ্ন দেখছি আমি। তুমি কেন শব্দ শুনবে! কুৎসিত স্বপ্ন। ধোয়া, চিৎকার, বালিশ দিয়ে মুখ চাপাচাপি।
চা নিয়া আসি স্যার।
যাও নিয়ে আস। চা আনার আগে একটা কাজ কর— আমার বালিশটা নিচে পড়ে গেছে। ধাক্কা খেয়ে খাটের নিচে চলে গেছে। বালিশটা দাও।
কুটু খাটের সামনে উপুড় হয়ে বসে বালিশটা এনে আলাউদ্দিনের হাতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। আলাউদ্দিন বালিশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বালিশের এক পিঠে ছোপছোপ রক্ত লেগে আছে। টাটকা রক্ত, এখনো শুকিয়ে কালচে হয় নি।
আয়াতুল কুরশি সূন্নাটা মনে পড়েছে। আলাউদ্দিন বিড়বিড় করে আয়াতুল কুরশি পড়ছেন…
আল্লাহু লাইলাহা ইল্লাহুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম। লতা খুজুহু সিনাতাও ওয়ালা নাওম! লাহু মা ফিছছামাওয়াতে ওয়াল আরদ্বি…
খুবই আশ্চর্যজনকভাবে রাতে আলাউদ্দিনের ভালো ঘুম হলো। ঘুমের ভেতর তিনি স্বপ্নও দেখলেন। কাটা কাটা স্বপ্ন। একটা স্বপ্নে তার বাবা মুনশি মোহম্মদ দুশির তাকে জিজ্ঞেস করছেন, রোজা ভেঙ্গেছিস কী জন্যে? তিনি বললেন, এটা তো রমজান মাস না। এখন রোজা রাখার প্রশ্ন আসছে কে? উত্তর শুনে মুনশি মোহম্মদ ছগির খুব রেগে গিয়ে বললেন– পরহেজগার আদমির জন্যে সারা বছরই রমজান মাস। রোজা ভেঙ্গেছিস, তার শাস্তি আগামী জুম্মাবারে মুসুল্লিদের সামনে এক লক্ষার কানে ধরে উঠবোস করবি। আলাউদ্দিন বললেন, জ্বি আচ্ছা। এরপর শুরু হলো কানে ধরে উঠবোসের স্বপ্ন দেখা। ছাড়া ছাড়াভাবে এই স্বপ্ন চলল ঘুম না ভাঙ্গা পর্যন্ত। তিনি উঠবোস করেই যাচ্ছেন, মুসুল্লিরা হো হো করে হাসছে। ঘুম থেকে উঠে তিনি চা খেলেন। হো হো হাসির শব্দের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। টিভিতে দর্শকদের উপস্থিতিতে কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। উপস্থাপকের প্রতিটি কথায় দর্শক হাসছে। আলাউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলেন। টিভির সাউন্ড অফ করা ছিল। এখন সাউন্ড আছে। আলাউদ্দিন সাউন্ড অফ করে দিলেন। তিনি রাতে যে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন এটা ভেবে তার একটু হাসিই পেল। হামিদা বানু ঠিকই বলেছে— উত্তপ্ত মস্তিষ্কের চিন্তা। শুধু যখন কুটুর কাছে শুনলেন গতকাল রাতে সাইফুল্লাহ সাহেবের বাড়িতে কী নাকি সমস্যা হয়েছে, সাইফুল্লাহ সাহেবের মাথা ফেটে গেছে, রক্তে বাড়ি ভেসে গেছে, শেষ রাতে এম্বুলেন্স এসেছে, পুলিশ এসেছে— তখন সামান্য খটকার মতো লাগল।
আলাউদ্দিন বললেন, পুলিশ এসেছিল কেন?
কুটু বলল, জানি না স্যার। সাইহি সাহেবের বাসায় কাইল রাইতে যে মেয়েটা ছিল পুলিশ তারে ধইরা নিয়া গেছে।