উনার কী হয়েছে?
ওল্ড এজ ডিজিজ। স্পেসিফিক কিছু না। সর্দি, কাশি, বুকে ব্যথা।
আলাউদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা। এখন তার ঘনঘন হাই উঠছে। মনে হচ্ছে চেয়ারে বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়বেন।
কবে নাগাদ ছাড়তে পারবেন?
দেখি, যত তাড়াতাড়ি পারি।
এক সপ্তাহের মধ্যে পারলে আমার খুব উপকার হয়।
আলাউদ্দিন মুম ঘুম চোখে বললেন, আচ্ছা। কিছু ভেবে যে বললেন তা না। তিনি চাচ্ছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাইফুল্লাহকে বিদায় করতে।
সাইফুল্লাহ বলল, ঢাকা শহরে ভাড়া বাড়ির এখন আর ক্রাইসিস নাই। এত ফ্লাট হয়েছে। মানুষের চেয়ে ফ্ল্যাট বেশি। যেখানে যাবেন টু লেট। প্রফেসর সাহেব একটু চেষ্টা নেন, যেন সাতদিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করতে পারেন। খুব উপকার হয়।
আলাউদ্দিন আবারো হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা।
দুটি মুরগির বিশেষ ভাজার পুরোটাই আলাউদ্দিন খেয়ে ফেললেন। শেষ টুকরাটা মুখে দিয়ে বললেন, খেতে খারাপ না। এরচে ভালো ভালো কথা বলা উচিত ছিল, কিন্তু আলাউদ্দিনের মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। শরীর দুলছে। এখন ভালো ভালো কথা বলার সময় না। তাছাড়া বাঙালিকে বেশি প্রশংসা করতে নেই। প্রশংসা করলেই বাঙালি এক লাফে আকাশে উঠে যায়। আকাশে উঠে গেলেও ক্ষতি ছিল না— আকাশ থেকে থুথু ফেলা শুরু করে। সেই থুথু এসে গায়ে পড়ে। এই জন্যেই বাঙালিকে মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন কথা বলে সাইজ করতে হয়। আলাউদ্দিন ঠিক করলেন কুটু মিয়ার মুরগির ভাজা যত ভালোই হোক তাকে আজ সাইজ করতে হবে। ঘুমুতে যাবার আগে তাকে ডেকে পাঠাবেন এবং ইচ্ছামতো সাইজ করে দেবেন। সাইজ করার মতো কর্মকাণ্ড সে করছে। তিনি দেখেও নাদেখার ভান করছেন।
এই যেমন আরেক ভদ্রলোকের বোতলের জিনিস উধাও। বোতল আছে, জিনিস নাই। পানি ভরে দিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে। এর শাস্তি দিতেই হবে।
তারপর আছে অন্ধকারে তার রান্না করার বিষয়টা। তিনি অনেক দিন থেকেই লক্ষ করছেন রাতেরবেলায় রান্নার সময় ঘরের সব আলো নেভানো থাকে। চুলার আগুনের শিখায় কিছুটা ভালো হয়। কটু হয়তো সেই আলোতেই দেখতে পায়। অনেকের দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে। কুটু হয়তো সেই অনেকের মধ্যে একজন। তবুও অন্ধকারে রান্না করা ঠিক না। পাতিলের ভেতর কোনো পোকামাকড় উড়ে পড়বে। কুটু সেটা দেখতে পাবে না। চিকেন ফ্রাই-এর পাশাপাশি মিডিয়াম সাইজ একটা মাকড়সাও ফ্রাই হয়ে পড়ে থাকল। তিনি পিয়াহ মনে করে খেয়ে ফেলবেন। কে জানে হয়তো এর মধ্যে খেয়েছেনও। এটা তো হতে দেয়া যায় না। কুটুকে এই বিষয়ে ধরতে হবে। কঠিন ধরা ধরতে হবে। আজ কুটুর ক্ষমা নেই। আজ কুটুকে সাইজ করা হবে। আজ হলো মহান সাইজ দিবস।
আলাউদ্দিন বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। তার মুখে জর্দা দেয়া মিষ্টি পান। জর্দার পরিমাণ বেশি হয়েছে। একেকবার পানের রস গিলছেন আর মাথা কেমন চুকুর দিয়ে উঠছে। এই চক্করটা ভালো লাগছে। খুবই আরামের চক্কর। আলাউদ্দিনের আঙুলের ফাকে সিগারেট। কুটু লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। আলাউদ্দিন সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, কুটু তোমাকে আজ কিছু কথা বলব।
কুটু বলল, জি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন বললেন, কথাগুলি কঠিন। শুনে তুমি হয়তো মনে কষ্ট পাবে। কষ্ট পেলেও আমার কিছু করার নেই।
কুটু বলল, জি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে কথা বলার জন্যে প্রস্তুত হলেন। কী বলবেন মনে পড়ছে না। মাথা একেবারেই ফাকা হয়ে আছে। যে সব কথা বলবেন বলে ঠিক করেছিলেন সে সব কথা পয়েন্ট আকারে একটা কাগজে লিখে রাখা দরকার ছিল। বিরাট ভুল হয়েছে।
কুটু!
জ্বি স্যার।
তোমার অনেক জিনিস আছে যা আমার অপছন্দ। এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলব। তুমি যদি নিজেকে বদলাতে পার তাহলে তুমি থাকবে, বদলাতে না পারলে চলে যাবে। ভাত ফেললে কাকের অভাব হয় না। বেতন ফেললে বাবুর্চি পাওয়া যায়। বুঝতে পারছ?
জি।
আলাউদ্দিন অনেক চেষ্টা করলেন, কুটুকে সাইজ করার মতো কোনো কথাই মনে পড়ল না। তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন— কুটু ঠিক আছে তুমি যাও। কথাবার্তা আজকের মতো মুলতবি। ঘুমের আগে আগে কঠিন কথাবার্তা না হওয়া ভালো। এতে সুনিদ্রার ব্যাঘাত হয়। একটা কাজ কর— আমাকে জর্দা দিয়ে আরেকটা পান দাও। জর্দা বেশি করে দিবে।
জি আচ্ছা।
আর টিভিটা চালু করে দাও। সাউন্ড দিও না। শুধু ছবি। টিভি দেখতে দেখতে ঘুমাব।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি মনে করো না যে তুমি ছাড়া পেয়ে গেলে। মামলা ডিসমিস হয়ে গেল। আসলে সাময়িক বিরতি। আদালত আবার বসবে। আমি নিজেই বাদি, আমিই বিচারক। তোমার খবর আছে কুটু মিয়া।
জর্দা ভর্তি পান মুখে নিয়ে আলাউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন। টিভি চলতে থাকল।
এক সময় আলাউদ্দিনের ঘুম ভাঙল। কোনো কারণ ছাড়াই তার বুক ধ্বক করে। উঠল। এই ঘরে কিছু একটা হয়েছে। ঘরটা বদলে গেছে। কোনো কিছুই মনে হচ্ছে আগের মতো নেই। ঘর ভর্তি ধোয়া। এত ধোয়া কোত্থেকে এলো। কোথাও কি আগুন লেগেছে! খড় পোড়ার গন্ধ ও নাকে আসছে। নাক জ্বালা করছে। খাটের নিচ থেকে গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। হাঁটাহাঁটি হচ্ছে। মাঝে মাঝে ক্ষীণ গলায় কেউ একজন বলছে— বাঁচান, আমারে বাঁচান। সে কথা শেষ করতে পারছে না। তার আগেই কেউ একন তার মুখ চেপে ধরছে। আবারো হুটোপুটি হচ্ছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ।