দীর্ঘদিন একা থাকিয়া থাকিয়া তোমার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। এই বয়সে বিবাহিত জীবনের কল্পনা মনে ভীতির সঞ্চার করে। ইহাই স্বাভাবিক। তুমি ইহা নিয়া কেন সংকোচ বোধ করিতেছ? মনের দিক হইতে সাড়া না পাইলে অবশ্যই তুমি বিবাহ করিবে না।
পত্র পাঠ করিবা মাত্র বাংলাবাজারে চলিয়া আসি। হস্তরেখা বিজ্ঞানের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হইলে সঙ্গে নিয় আসি। পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ না হইলে ও যাহা হইয়াছে নিয়া আসিবা। আমি কম্পােজ ধল্লাইয়া দিব। খোজ নিয়া জানিয়াছি ইদানীং ক্রিকেট খেলার উপর লেখা বই ভালো চলিতেছে। ক্রিকেটের উপর একটি দশ ফর্মার বই অতি দ্রুত তোমাকে দিয়া লেখাইতে চাই। ক্রিকেট বিষয়ে লেখার জন্য প্রয়োজনীয় বইপত্র সংগ্রহ করার জন্যে তোমার বাংলাবাজার আসা প্রয়োত্তান।
আজ এই পর্যন্তই।
দোয়া গো, হাজী একরামুল্লাহ
পুনশ্চ : রয়েলটি বাবদ প্রাপ্ত এগারো হাজার পঁচিশ টাকা দোকানের ক্যাশিয়ার মালেক মিয়ার কাছে দেওয়া আছে।
টাকাটা সংগ্রহ করিও। চিঠি পড়ে আলাউদ্দিন স্বস্তি পেলেন। এমনিতেই তার মন আনন্দে ছিল। সেই আনন্দ অনেক বাড়ল। নিজেকে মহাসুখী মানুষদের একজন মনে হতে লাগল। টমেটো জুসটা খেতে এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি ভালো লাগছে। এই গ্রাস শেষ করার পরও তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। পাইলট সাহেবের মতো ব্যবস্থা করতে হবে। জগ ভর্তি জুস থাকবে। নিজের ইচ্ছামতো যাবেন। কিছুক্ষণ পরপর কুটু মিয়াকে ডাকতে হবে না। কুটু মিয়ার জন্যেও ভালো। একবারে বানিয়ে রেখে দেয়া। বারবার বানাতে হবে না।
আলাউদ্দিন রিমোট কন্ট্রোলে টিভি ছাড়তে যাবেন— কুটু মিয়া ঘরে ঢুকল, বিড়বিড় করে বলল, স্যার আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে আসছে।
এত রাতে কে ভাসলো?
পাশের ফ্লাটের সাইফুল্লাহ সাহেব।
নিয়ে এসো। এখানে নিয়ে এসো।
এইখানে আনার দরকার নাই।
ঠিক বলে। এখানে মানার দরকার নাই। খাচ্ছি টমেটো জুস, হয়তো ভাববে অন্যকিছু খাচ্ছি। শুধু যে মনে করলে তা না মারো দশজনকে গিয়ে বলবে। বাঙালির স্বভাবই এই রকম। স্বভাবের কারণে বাঙালি কিছু করতে পারল না। কাজ করার সময়ই বাঙালির নাই। সারাক্ষণ এর কথা তার কাছে লাগাচ্ছে, কাজ করার সময় কোথায়? ঠিক বলছি না?
জ্বি স্যার ঠিক বলছেন। উনি বসার ঘরে বইসা আছেন।
কে বসার ঘরে বসে আছে?
সাইফুল্লাহ সাহেব।
সাইফুল্লাহ সাহেব বসার ঘরে বসে আছেন কেন?
আপনাকে একটু আগে বলছি।
একটু আগে কী বলেছ আমি ভুলে গেছি।
সাইফুল্লাহ সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। কী কথা জানি বলবেন।
আলাউদ্দিন নিতান্ত অনিচ্ছায় বিছানা থেকে নামলেন। একবার বিছানায় উঠে পড়লে আর নামতে ইচ্ছে করে না। সাইফুল্লাহ না এলেও বিছানা থেকে নামতে হতো। প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। কষ্ট করে চেপে রেখেছেন। এখন মনে হয় তলপেট ফেটে যাচ্ছে। বিছানাতেই বাথরুম করা যাচ্ছে এমন ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।
সাইফুল্লাহ আলাউদ্দিনকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ভাই আপনার শরীর খারাপ?
আলাউদ্দিন বললেন, না তো।
দেখে মনে হচ্ছে শরীরে পানি এসেছে। হাত-পা ফুলে গেছে।
আলাউদ্দিন কিছু বললেন না। সাইফুল্লাহ তাড়াতাড়ি বিদেয় হলে তিনি বাঁচেন। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে পারেন। টমেটো জুসের গ্লাসটায় এখনো অর্ধেকের মতো আছে। গ্লাসটা শেষ করা দরকার।
সাইফুল্লাহ গলা নামিয়ে বলল, আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।
বলুন।
কথা আসলে একটা না, দুটা। কোনটা আগে বলব বুঝতে পারছি না।
যে কথাটা শুনতে ভালো লাগবে সেটা আগে বলুন।
দুটা কথাই শুনতে খারাপ লাগবে।
আলাউদ্দিন বসলেন। কাঠের চেয়ারে বসে তিনি আরাম পাচ্ছেন না। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় থেকে থেকে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। শুয়ে না পড়া পর্যন্ত ভালো লাগে না। সাইফুল্লাহ কথাগুলি তাড়াতাড়ি শেষ করলে তিনি নিজের জায়গায় চলে যেতে পারেন। কোলবালিশে পা রেখে শুয়ে পড়তে পারেন।
প্রফেসর সাহেব, কাটা হচ্ছে আমি আপনার ফ্রিজে দুই বোতল ভদকা রেখেছিলাম। আমার বন্ধুর জিনিস। সে রাখতে দিয়েছিল। গত সপ্তাহে বোতল দুটা ফেরত নিয়েছি কিন্তু ভিতরে জিনিস নাই— পানি।
আপনার কথা বুঝলাম না।
দুটা বোতলের ভদকা সরিয়ে নিয়ে পানি ভরে রেখেছে।
কে সরিয়ে রেখেছে?
কে সরাবে আপনার কাজের ছেলে কুটু না ঘুটু কী যেন নাম।
সে ভদকা কী করেছে?
খেয়ে ফেলেছে। কিংবা বিক্রি করে দিয়েছে।
বলেন কী?
আমি তাকে ইনটারোগেট করেছি। কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। এমনভাবে তাকায় যেন আমার কোনো প্রশ্নই বুঝতে পারছে না। এই চিড়িয়া জোগাড় করেছেন কোত্থেকে?
আলাউদ্দিন জবাব দিলেন না। সাইফুল্লাহ বলল, যত তাড়াতাড়ি পাবেন একে বিদায় করেন। যে ভদকার বোতলের ভদকা সরিয়ে পানি ভরে রাখতে পারে সে ছোটখাট চোর না। বড় চোর।
চিন্তার বিষয়।
অবশ্যই চিন্তার বিষয়। আপনি একা থাকেন, কখন আপনাকে কী করবে আপনি বুঝতে পারবেন না। দুপুরে ঘুমিয়ে আছেন, পেটে ছুরি মেরে টাকা পয়সা নিয়ে চলে গেল।
আলাউদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, দ্বিতীয় খারাপ কথাটা কী?
সাইফুল্লাহ গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, আপনাকে তো ফ্ল্যাট সাবলেট দিয়েছিলাম। পুরো ফ্ল্যাটটাই এখন আমার দরকার। বাবা অসুস্থ। ঢাকায় থেকে চিকিৎসা করাবেন।
ফ্ল্যাট করে ছাড়তে হবে?
যত তাড়াতাড়ি পারেন এত ভালো। বাবাকে আমার ইমিডিয়েটলি ঢাকায় আনা দরকার।