আলাউদ্দিন হাতের গ্লাস শেষ করে টেবিলে রাখলেন। শব্দ করে যে রাখলেন তা না। স্বাভাবিকভাবেই রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা গ্লাস ভর্তি টমেটো জুস নিয়ে কুটু ঢুকল। খালি গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল। আস্থা কুটু কি আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে? তাকিয়ে না থাকলে তো বোঝা সম্ভব না– গ্লাস কখন খালি। হলো? কুটুর তো এটা করা ঠিক না। সে আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকবে কেন? আলাউদ্দিন তাকে এই ব্যাপারটা কঠিন গলায় বুঝিয়ে দেবার জন্যে ডাকলেন। কুটু। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল। কুটুর গা থেকে মশলার গন্ধ আসদু। কিছু একটা ব্রাধছিল। নিশ্চয়ই। মশলার গন্ধেই তার ক্ষিধে লেগে গেল। কুটুকে কী জন্যে ডেকেছেন ভুলে গিয়ে বললেন, আজকের রান্না কী কুটু।
কৈ মাছের ঝোল।
আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, শুধু কৈ মাছের ঝোল?
সাথে একটা মুরগি রাঁধছি।
মুরগির ঝোল?
জ্বি না, একধরনের ফ্রাই। পাইলট স্যারের খুব পছন্দের রান্না ছিল। সপ্তাহে তিন চার দিন খাইতেন। দুইটা মুরগি তিনি একা খাইতেন।
বলো কী?
ঠিক মতো রান্না হইলে দুইটা মুরগি খাওয়া কোনো ব্যাপার না স্যার। আপনিও পারবেন।
আমি কীভাবে পারব? আমি কি বক রাক্ষস নাকি? মুরগি কটা বেঁধেছ?
দুইটা।
সর্বনাশ! তুমি তো আমাকে ফতুর বানিয়ে ছাড়বে। দিনে দুটা মুরগি মানে মাসে ষাটটা মুরগি। বৎসরে সাতশ বিশটা মুরগি। যাই হোক, জিনিসটার প্রিপারেশন কী?
কুটু মাথা নিচু করে বলল, এইটা বলা নিষেধ।
নিষেধ মানে? কার নিষেধ?
কুটু চুপ করে রইল। আলাউদ্দিন উদার গলায় বললেন, থাক বলতে হবে না। জেনেই আমি কী করব? আমি তো আর রাধতে বসব না। শোন কুটু, আমি শ্রোমার কাজকর্মে সন্তুষ্ট।
শুকরিয়া।
শুধু সন্তুষ্ট না। খুবই সন্তুষ্ট। বাঙালির সমস্যা হলো তার প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। একটু প্রশংসা করলেই তার লাফ দিয়ে মাথায় উঠে যায়। এই জন্যে প্রশংসা করা বাদ দিয়েছি।
কুটু কিছু বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আলাউদ্দিন হড়বড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। কথা বলতে তার খুবই ভালো লাগছে। ব্লাডিমেরি নামের জিনিসটার গুণ বা দোষ হলো এটা খেলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে। পেটের ভেতর যত কথা আছে সব বুলবুলের মতো পেট থেকে বের হতে শুরু করে।
কুটু!
জ্বি স্যার।
আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট।
একবার বলেছেন সার।
একবার বলেছি তো কী হয়েছে? আরেকবার বলব। দরকার হলে আরো দশবার বলব। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট…
আলাউদ্দিন আঙুল গুণে গুণে দশবার বললেন। তার হাতের ব্লাডিমেরির গ্লাস শেষ হয়েছে। তিনি গ্লাস নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন তোমার বানানো এই টমেটোর রস আমার পছন্দ হয়েছে। টমেটোর রসে তুমি কী দিয়েছ না দিয়েছে জানতে চাচ্ছি না। হয়তো ভদকা দিয়েছ ৷ দিয়ে থাকলে খুবই অন্যায় করেছ। আমি তোমাকে বলেছিলাম মদ ফাদ আমি খাই না। আমি শিক্ষক মানুষ। ভদ্রঘরে সন্তান। আমার পিতা ছিলেন বিশিষ্ট আলেম। মৃত্যুর দিনও তার নামাজ কাজা হয়। নাই। বুঝতে পারছ?
জি স্যরি।
তবে টমেটোর রস অতি সুখাদ্য। দুগ্লাস খাওয়ার পর মনে হয় আরো দুগ্লাস খাই। তোমার পাইলট সার কয় গ্লাস খেত?
উনার জন্যে জগ ভর্তি বানায়ে রাখতাম। কোনো কোনো দিন পুরা জগ শেষ করতেন। কোনো কোনো দিন জগ থেইকা ঢাইলা সামান্য খাইতেন।
আমার জন্যেও তাই করবে। যতটুক খাই খাব। ইচ্ছা হলে খাব। ইচ্ছা হলে খব না।
জি আচ্ছা।
খানা কি তৈরি হয়েছে?
জি।
তাহলে খানা দাও।
যদি চান আরেক গ্লাস ব্লাডিমোরি বানায়ে দেই। রাত দশটা এখনো বাজে নাই। এখনই খানা খাইয়া ফেলবেন?
সেটাও একটা কথা। এখনই খানা খেয়ে ফেলা ঠিক না। পারে আবার ক্ষিধা লাগতে পারে। দাও তোমার ঐ জিনিস আরেক গ্রাম।
আপনার একটা চিঠি ছিল স্যার। চিঠিটা দিব? চিঠি কখন এসেছে?
সন্ধ্যাবেলায় আসছে। আপনি আরাম কইরা টিভি দেখতেছিলেন এই জন্যে তখন দেই নাই। এখন টিভি দেখছেন না এই জন্যে চিঠির কথা তুললাম।
ভালো বিবেচনা দেখিয়েছ। এই যে বললাম তোমার বিবেচনায় আমি সন্তুষ্ট। চিঠি নিয়ে আস। চিঠি আর জুস একসঙ্গে দাও। জুস খেতে খেতে চিঠি পড়ব। তার মজা অন্যরকম। চিঠি আবার আমাকে কে লিখবে! আমাকে চিঠি লেখার লোক নাই। এটা একদিক দিয়ে ভালো। ঝামেলা নাই। ঠিক না?
জ্বি ঠিক।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? চিঠি আর জুস নিয়ে আস।
চিঠি লিখেছেন হাজী একরামুল্লাহ। তিনি লিখেছেন–
আলাউদ্দিন
দোয়াবরেষু,
বুধবারে তোমার হস্তরেখার পুস্তকটির পাণ্ডুলিপি আমাকে পৌছাইয়া দেওয়ার কথা। বুধবার চলিয়া গিয়াছে, আজ শনিবার। তোমার কোনোই সংবাদ নাই। এমন ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটে নাই। আশা করি তোমার কোনো অসুখ বিসুখ হয় নাই। অসুখ হউক বা যাই হউক একটি সংবাদ তুমি দিতে পারিতে। নিজে আসিতে না পারিলে ও টেলিফোনের মাধ্যমে সংবাদটি দেওয়া যাইত। আমার বাসা এবং দোকানের টেলিফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে। সম্প্রতি আমার মোবাইল নাম্বার ও তোমাকে দিয়াছি। তোমার নীরবতার আমি। কোনোই অর্থ বুঝিতে পারিতেছি না।
আমার মনে একটি ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিয়াছে। সন্দেহের ব্যাপারটি খোলাখুলি তোমাকে বলি। কোনোরকম অস্পষ্টতা থাক আমি কাঞ্ছনীয় মনে করি না। আমার সন্দেহ হামিলা বানুকে বিবাহের ব্যাপারে তোমার মত নাই। যেহেতু প্রস্তাব আমি দিয়াছি; চক্ষুলজ্জায় বিবাহ মত নাই— এই কথা বলিতে পারিতেছ না। এই সমস্যায় পড়িয়া তুমি আমার নিকট আসা বন্ধ করিয়াছ।