কুটু গলা নামিয়ে বলল, ভদকা ঘরে আছে স্যার। ফ্রিজে এক বোতল আছে।
আলাউদ্দিন আঁতকে উঠে বললেন, ফ্রিজে ভদকা কোথেকে আসলো।
পাশের ফ্ল্যাটের সাইফুদ্দিন সাহেব রাইখা গেছেন। তার বন্ধুরা দেখলে খাইয়া ফেলবে এই জন্যে রাইখা গেছেন।
খবরদার তুমি ভদকা ফদকা দিয়ে কিছু বানাবে না। আমাদের পুরো পরিবার ইসলামিক লাইনের। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়কার কথা— এক রমজান মাসের শুক্রবার রোজা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম বলে জুম্মা নামাজের পরে সকল মুসুল্লীর সামনে আমাকে একশৰার কানে ধরে উঠবোস করতে হয়েছে। এই ছিল আমাদের পরিবার। মনে থাকবে?
জ্বি।
গরম পানি তো শেষ হয়ে গেছে। আরেক বালতি গরম পানি থাকলে ভালো হত।
এখন ঠাণ্ডা পানি ঢালব? এতে আরাম বেশি পাইবেন।
দাঁড়াও, আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নেই।
আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরালেন। কুটু তার মাথায় পানি ঢালছে। আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ঘরের বাতি নেভানো
ঘরের বাতি নেভানো। শুধু একটা ঘরেরই না, সব ঘরের বাতি নেভানো। আলাউদ্দিনের ঘরে টিভি চলছে। টিভি স্ক্রিনের নীলচে আলোয় তাঁর ঘরটা আলোকিত। বারান্দায় বাতি জ্বলছিল, কিছুক্ষণ আগে কুটু মিয়া সেই বাতিও নিভিয়ে দিয়েছে।
খাটের ওপর আলাউদ্দিন পা দুড়িয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। তার একটা পা। কোলবালিশে রাখা। দুটা কোলবালিশ কুটু মিয়া গত পরশু কিনে এনেছে। মাখনের মতো মোলায়েম কোলবালিশ। আলাউদ্দিন খুব আরাম পাচ্ছেন। নরম কোলবালিশে একটা পা উঠিয়ে দেয় যে এত আনন্দময় তা তিনি আগে বুঝতে পারেন নি। বুঝতে পারলে অনেক আগেই কোলবালিশ কিনতেন।
আলাউদ্দিনের হাতে টিভির রিমোট কনট্রোল। ক্যাবল লাইনে সতেরোটা চ্যানেল দেখা যায়। তিনি সতেরোটাই দেখেন। আগে প্রতিটি চ্যানেল বদলাবার আগে চার পাঁচ মিনিট দেখতেন। এখন কোনোটাই এক দেড় মিনিটের বেশি দেখেন না। কিছু বোঝার আগেই পর্দার দৃশ্য বদলে যায়। এই ব্যাপারটা তার খুবই ভালো লাগে। এই গান, এই খেলা, এই নাচ, এই খবর…
তার লেখার টেবিলটা এখন খাটের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস টেৰিলে আছে। একবার টিভি দেখা শুরু করলে বিছানা থেকে নামার প্রয়োজন পড়ছে না। সিগারেটের প্যাকেট আছে, এঐে আছে, ম্যাচ আছে। তাঁর সর্দির ধাচ। একটু পর পর নাক ঝাড়তে হয়। সে জন্যে এক বাবা টিস্যু পেপার আছে। মাঝে মাঝে কান চুলকাতে তার খুবই আরাম লাগে। কান চুলকার এক বাক্স কটন বাড আছে। পানির বোতল আছে। গ্লাস আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই আয়োজনের জন্য কুটুকে কিছু বলতে হয় নি। সব মে নিজ থেকে করেছে। তাঁর আরামের দিকে কুটুর নজর দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। আগে তোষকের বিছানায় ঘুমাতেন, এখন ঘুমাচ্ছেন ফোমের বিছানায়।
অতিরিক্ত আরাম আয়াসের কারণ একটা ক্ষতি হচ্ছে লেখালেখি হচ্ছে না। হস্তরেখা বিজ্ঞান-এর শিররেখার চ্যাপ্টারটা এখনো শেষ হয় নি। বই শেষ করাটা খুবই জরুরি। রয়েলটির টাকাটা পাওয়া যাবে। একশ টাকা দামের বই যদি হয় সাড়ে বার পার্সেন্ট রয়েলটি হিসেব করলে খারাপ হয় না। তবে টাকা পয়সার সমস্যা নিয়ে আলাউদ্দিন এখন দুশ্চিন্তা করছেন না। হঠাৎ করে কিছু টাকা তার হাতে চলে এসেছে। এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকায় বসত বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। দেশের বাড়ি যাওয়া হয় না। মানুষ হয়েছে শহরবাসী। খামাখা বাড়ি পড়ে থাকবে। গরু-ছাগল চড়বে। দরকার কী!
একলা পঁচিশ হাজার টাকা আলাউদ্দিন ব্যাংকে জমা দেন নি। ঘরেই আছে। সুটকেসে তালাবন্ধ আছে। সুটকেসের চাবি আছে টেবিলের ড্রয়ারে। এটা নিয়ে। তিনি কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করেন না। কারণ কুটু মিয়া টাকা পয়সার ব্যাপার অসম্ভব সৎ। তাছাড়া সারা দিন তো তিনি ঘরেই থাকেন। বেশির ভাগ সময় আধসোয়া হয়ে খাটের ওপরই থাকেন। এক ধরনের বিশ্রাম। এই বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। বিশ্রামের সময় টিভি দেখতে দেখতে নানান কথা চিন্তা করতে তার ভালো লাগে।
বেশির ভাগ সময় যে কল্পনাটা করেন তা হচ্ছে–হামিদা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। দুজনে বড় একটা খাটে আধাশোয়া হয়ে আছেন। দুজনের হাতেই টিভির রিমোট কন্ট্রোল। টিভি দেখতে দেখতে দুজনে গল্প করছেন। চ্যানেল বদলাচ্ছেন। কখনো তিনি বদলাচ্ছেন, কখনো বদলাচ্ছে হামিদ।
আলাউদ্দিন কিছুক্ষণের জন্যে টিভি বন্ধ করলেন। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কুটু মিয়া বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে দিল। টিভি বন্ধ হলে কোথাও না। কোথাও বাতি জ্বলে উঠবে। আলোর অভাব হবে না। আলাউদ্দিন মনে মনে বললেন, ভেরি হও। যতই দিন যাচ্ছে কট মিয়াকে তার ততই পছন্দ হচ্ছে। আলাউদ্দিন হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে পিরিচ দিয়ে ঢাকা গ্লাসটা নিলেন। গ্লাসে টমেটোর রস। গত কয়েক দিন হলো রাতের খাবারের আগে কুটু মিয়া দু গ্লাস টমেটোর রস বানিয়ে দিচ্ছে। টক টক, ঝাল ঝাল। অতি সুস্বাদু পানীয়। এর সঙ্গে সে ভদকা না না মিশাচ্ছে কি-না তিনি জানেন না। জানতে চাচ্ছেন না। যদি দুএক চামচ মিশিয়েও দেয় তাহলে দিল। তিনি তো আর বলেন নি কটু আমাকে ভদকা দিয়ে টমেটো সস দাও। তোমাদের পাইলট স্যার যে রকম খেলেন সে রকম। ব্লাড়িমরি না কী যেন নাম। কুটু যা করছে নিজ দায়িত্ব করছে। তাকেও ঠিক দোষ দেয়া যায় না। এইসব জিনিসই সে বানিয়ে অভ্যস্ত। আসল কথা হলো ক্রিনিসটা খেতে ভালো। দুটা গ্লাস খাওয়ার পর শরীরে চনমনে ভাব আসে। আবার একই সঙ্গে আলসেমিও লাগে।