যাই হোক তুমি সময় নাও। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ কর। আমিও হামিদাকে জিজ্ঞেস করে দেখি তার মতামত কী?
উনি বিবাহ করবেন না।
হামিদা বিয়ে করবে কি করবে না— সেটা তার বলার কথা। তুমি বলছ কেন? আগবাড়িয়ে কথা বলবে না।
জি আচ্ছা।
তোমার সঙ্গে তাহলে আগামী বুধবার আবার দেখা হবে।
জি।
লেখা শেষ করে নিয়ে আসবে।
জি আচ্ছা।
বলেই আলাউদ্দিন হাঁটা শুরু করলেন। যেন তাঁর বাড়ি ফেরার খুবই তাড়া। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না।
বাসায় ঢুকে আলাউদ্দিনের মন ভালো হয়ে গেল। তিনি স্বস্তি ও আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেন। এতক্ষণ বুকের উপর পাথর চেপে ছিল। এখন পাথরটা নেই। নিজেকে খুবই হালকা লাগছে। নিজের বাসায় ফিরে এত আনন্দ এর আগে তিনি পেয়েছেন বলে মনে পড়ল না।
কুটু মিয়া?
জ্বি স্যার।
গোসল করব। গরম পানি দাও। শরীর ঘামে ভর্তি। আজ গরম পানি দিয়ে সাবান দিয়ে হুলুস্থুল করব।
গরম পানি দেওয়া আছে স্যার।
বলো কী! তুমি দেখি অন্তর্যামী হয়ে যাচ্ছ। অন্তর্যামী কি জানো? যে মনের কথা বলতে পারে সে অন্তর্যামী। রাতের খাবার কী কুটু মিয়া?
রাতে মাংস করেছি স্যার।
ইলিশ মাছের ডিমের কী হলো?
ডিমও আছে।
গুড ভেরি গুড। হিলসা ফিস, এগ কারি।
আলাউদ্দিন বাথরুমে ঢুকলেন। বালতি ভর্তি গরম পানি। সাবান তোয়ালে সব সাজানো। বাথরুমের দরজার ওপাশ থেকে কুটু বলল, চা খাইবেন স্যার?
আলাউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, গোসল করতে করতে চা খাব কীভাবে?
আপনি চা খাইবেন, আমি গায়ে সাবানের ডলা দিব।
আলাউদ্দিন ইতস্তত করতে লাগলেন। হ্যাঁ বলবেন না-কি না বলবেন মনস্থির করতে পারছেন না। কুটু মিয়া ঘরদুয়ার ঝকঝকে করে রাখে কিন্তু তাকে দেখে। নোংরা মনে হয়। মনে হয় দীর্ঘ দিন এই লোক গোসল করে নি। গা থেকে সব সময় বাসি তরকারির গন্ধের মতো গন্ধ আসে। আলাউদ্দিন বললেন, আন দেখি এক কাপ চা। আর ইয়ে, পিঠে সাবান ডলে দাও সারা শরীরে সাবান ডলার দরকার নেই।
চা মনে হয় তৈরিই ছিল। নিমেষের মধ্যে কুটু মিয়া চা এনে দিল। আলাউদ্দিন। একটা সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। কুটু মিয়া পিঠে সাবান ডলছে। গরম পানি ঢালছে। আলাউদ্দিনের কাছে মনে হচ্ছে তিনি এত আরাম তার সারা। জীবনে পান নি। আরামে বারবার তার চোখ বুজে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঘুমিয়ে পড়লেন। চা সিগারেট খেতে খেতে গোসলের এত আনন্দ কে জানত!
কুটু।
জ্বি স্যার।
দাও সারা শরীরেই সাবান মাখিয়ে দাও। যাহা বাহান্না তাহা তিপ্পান্ন।
জি আচ্ছা স্যার।
এত ভালো ম্যাসাজ শিখেছ কোথায়?
কোনো খানে শিখি নাই স্যার। পাইলট স্যারের শইল ম্যাসাজ করতাম।
উনিও কি চা সিগারেট খেতে খেতে গোসল করতেন?
জ্বি না। উনার বাড়িতে বাথটাব ছিল। বাথটাবে গরম পানি দিতাম। ফোম দিয়া ফেনা তুলতাম। উনি শুইয়া শুইয়া ব্লাডি মেরি খাইতেন আর আমি শইল টিপতাম।
ব্লাডিমরি কী জিনিস?
একটা মিকচার। খাইতে অতি সুস্বাদু।
তুমি বানাতে পার?
জ্বি পারি। পাইলট স্যারের কাছে শিখেছি।
বানাতে কী কী লাগে?
অনেক কিছু লাগে। তিন আংগুল ভদকার মধ্যে…
আলাউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, ভদকা মদ না?
কুটু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
থাক বলার দরকার নাই। আমি শিক্ষক মানুষ। মদ বিষয়ে কোনো কথা শোনাই আমার ঠিক না। আমার বাবা ছিলেন আমাদের অঞ্চলের জামে মসজিদের ইমাম। জীবনে কোনো ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেন নাই। আছর ওয়াক্তে তাঁর মৃত্যু হয়। আছরের নামাজও তাঁর কাজ হয় নাই। নামাজ শেষ করে বিছানায় শুয়েছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু।
কুটু মিয়া কথা বলছে না। নীরবে সাবান মাখিয়ে যাচ্ছে। গায়ে গরম পানি ঢালছে। শরীর ম্যাসাজ করছে। আলাউদ্দিন ভাবছেন এই আরামে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতো না।
কুটু মিয়া।
জি স্যার।
তোমার পাইলট স্যার খুব মদ খেতেন?
চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর খুব বেশি খাইতেন। একা মানুষ। কিছু করার নাই।
একা মানুষ কেন?
স্ত্রী মারা গেছিলেন। ছেলেমেয়েরা বড় হইয়া চইলা গেছে দেশে বিদেশে।
আমার মতো অবস্থা। সে ছিল নী আমি গরিব– বেশক এইটা, ঠিক না। প্রাইভেট কলেজের শিক্ষক ছিলাম। বেতনের কারবার নাই। ছাত্রই নাই বেতন কোত্থেকে আসবে। কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষক এর তার বাড়িতে লজিং-এর মতো থাকত। নামেই কলেজের শিক্ষক। অসলে লবডঙ্কা। লবডঙ্কা মানে জানো?
জ্বি না।
মানে জানার দরকার নাই। শরীর টিপছ, শরীর টিপ।
জি আচ্ছা।
ব্লাডিমেরি জিনিসটা কীভাবে বানায় বলো তো শুনি। খাচ্ছি না যখন তখন তো আর দোষ হচ্ছে না। কীভাবে বানায় শুনে রাখি। তিন আঙুল ভদকা। তারপর কী?
ওয়েস্টার সস ছয় ফোঁটা, তাবাসসুম সাত ফোঁটা, গোল মরিচের গুঁড়া- লবণের চামচের আধা চামচ লেবুর রস চায়ের চামচে আধা চামচ, ট্রিপল সেক এক ফোঁটা। একটা কাচামরিচ মাঝখান দিয়া ছিইল্যা তার অর্ধেকটা। এইসব জিনিস এক সাখে মিশানোর পরে দিতে হইব টমেটো জুস। ডীপ ফ্রিজে রাখতে হইব দশ মিনিট। ডিপ ফ্রিজ থেইকা বাইর কইরা বরফের কুচি দিয়া খাইতে হইব।
বলো কী? এই জিনিস পাইলট সাহেব রোজ খেতেন?
জি। দিনে এই জিনিস, রাতে মার্গারিটা খাইতেন।
সেটা কী?
মার্গারিটা খাইতে খুবই সুস্বাদু।
যত সুস্বাদুই হোক আমি এর মধ্যে নেই। তাছাড়া তুমি যে সব জিনিসের কথা বললে বাংলাদেশে এইসব নিশ্চয়ই পাওয়া যায় না। ভদকা পাওয়া যায় রাশিয়াতে। রাশিয়া থেকে তোমার পাইলট সাহেবের পক্ষেই ভদকা আনা সম্বুল। আমার পক্ষে না।