আশহাব গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, চিয়ার্স। সে ঠিক করেছে গ্লাসে চুমুক দেবে না। দ্রতা রক্ষার জন্যে গ্লাস হাতে নিয়ে বসে থাকবে। মাঝে মাঝে গ্লাসে ঠোঁট লাগাবে। চুমুক দেয়ার ভান করবে।
সাজেদার বগীর দরজা সামান্য খোলা
সাজেদার বগীর দরজা সামান্য খোলা। করিডোর থেকে দেখা যাচ্ছে তিনি হেলান দিয়ে আছেন। তাঁর চোখ ভেজা। মাঝে মাঝে তিনি গায়ের পাতলা চাদর দিয়ে চোখ মুছছেন। চোখ মুছার কারণে ঠোঁটের পানের রসও মুখের নানান জায়গায় লাগছে। তাঁকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
চিত্রা করিডোর থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার হাতে ছোট্ট ঠোঙায় জর্দা। ট্রেন কিছুক্ষণের জন্যে কি একটা স্টেশনে থেমেছিল। পান-সিগারেট ওয়ালার কাছ থেকে সে পাঁচ টাকার জর্দা কিনেছে। চিত্রা বগীতে ঢুকবে কি টুকবে না বুঝতে পারছিল না। মোটামুটি অপরিচিতা এক মহিলা চোখ ভাসিয়ে কাঁদছেন। এই সময় কি তাঁকে বিরক্ত করা উচিত? ব্যক্তিগত দুঃখ যাপনের সময় উপস্থিত হওয়া যায় না।
চিত্রাকে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল না। সাজেদা হাত ইশারায় তাকে ডাকলেন। চিত্রা বগীতে ঢোকামাত্র তিনি বললেন, আমার ছেলেটিকে দেখেছ?
চিত্রা বলল, জি না। আমি আপনার জন্যে জর্দা এনেছি।
সাজেদা বললেন, ফেলে দাও। আমি ঠিক করেছি জীবনে জর্দা খাব না।
চিত্রা বলল, আমি কি আপনার ছেলেকে খুঁজে বের করব?
খুঁজে বের করতে হবে না। তুমি বোস। দরজা বন্ধ করে বোস। তোমাকে আমি কিছু কথা বলব।
চিত্রা দরজা বন্ধ করে পাশে বসল। সাজেদা বললেন, আমার ছেলের চেহারা দেখে কি কেউ বলবে সে হাড় বজ্জাত? কেউ বলবে না। শান্ত শিষ্ট চেহারা! ভদ্র ব্যবহার। হাসি ছাড়া মুখে কথা নাই। তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই হেসে হেসে অনেক কথা বলেছে। বলে নাই?
জি, বলেছেন।
ম্যাজিক দেখায়েছে, তাই না?
চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, না তো।
সাজেদা বললেন, গুণধর পুত্র। তার নানান গুন। তিনি একজন শখের ম্যাজিশিয়ান-টাকার ভিতর দিয়ে পেনসিল ঢুকাবে টাকা ছিড়বে না। হাতে পয়সা নিয়ে অদৃশ্য করে ফেলবে তারপর কারো নাক থেকে বের করবে। তাসের তিনটা সাহেব হয়ে যাবে তিনটা বিবি। ম্যাজিকের সব জিনিস সব সময় তার পকেটে থাকে। তোমাকে এখনো দেখায় নি?
না।
দেখাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখাবে। পয়সা বের করার কথা বলে তোমার কানে হাত দেবে। নাকে হাত দেবে। মেয়েছেলের গায়ে হাত দেয়ায় আনন্দ আছে না। মহানন্দ।
আপনি মনে হয় উনার উপর খুব রেগে আছেন।
সাজেদা কড়া গলায় বললেন, রেগে থাকব কেন? আমি তার উপর দিলখোশ। সে এখানে ঢুকলেই তাকে আমি কোলে বসিয়ে গালে চুমা দিব আর ও আমার বাবা ও আমার সোনা বলে মাথায় হাত বুলাব। সে একবার কামরায় ঢুকে দেখুক। কতবড় সাহস! আমার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে কথা বলে। বুক ফুলিয়ে বলে, আমি কয়েকবার মদ খেয়েছি। কি বিরাট কাজ করে ফেলেছ। তোমার মা হিসেবে আমার কত গর্ব হচ্ছে। আমার সোনা মানিক মদ খায়, কি আনন্দ! এত আনন্দ আমি কোথায় রাখি। আমার সোনা মানিককে মদ খাওয়ার জন্যে সোনার মেডেল দেব। মেডেলে লেখা থাকবে মদারু শ্রেষ্ঠ।
কথাবার্তায় সাময়িক বিরতি পড়ল। সাজেদা পান সাজতে বসলেন। চিত্রার হাত থেকে জর্দার প্যাকেট নিয়ে এক গাদা জর্দা পানে ঢাললেন। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে চিত্রা বলল, রাতে আপনি কখন খাবেন? বুফে কারে খেতে হলে আগে অর্ডার দিতে হবে। ওরা তাই বলল।
সাজেদা বললেন, খাবার আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। হট পটে গরম খাবার আছে। তুমিও আমার সঙ্গে খাবে। আশহাব বাদ। মদারু ছেলের সাথে বসে আমি খাব না। মা, তুমি একটা কাজ কর–আমার মদারু পুত্রকে ডেকে আন। তুমি ওর সঙ্গে কামরায় ঢুকবে না। আমি এমন কিছু ঘটনা ঘটাব যা তোমার দেখা ঠিক হবে না। কথায় বলে সাপের পাঁচ পা দেখা—আমি মদারুটাকে সাপের পঞ্চাশ পা দেখাব।
চিত্রা বগী থেকে বের হল। করিডোরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে রওনা হল বুফে কারের দিকে। বুফে কারে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়েছিল। অর্ডার ক্যানসেল করতে হবে। এই মহিলা তাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না এটা বুঝা যাচ্ছে। শুধু যে খাওয়াবেন তা-না, নানান অত্যাচারও করবেন। ভালবাসা দেখাতে গিয়ে অত্যাচার।
রশীদ সাহেব ধাক্কার মতো খেয়েছেন। ডাক্তার ছেলেটা যে এত ওস্তাদ তিনি কল্পনাও করে নি। তাঁর মতো সজাগ চোখের একজন মানুষকে বোকা বানানো সম্পূর্ণ অসম্ভব। অথচ এই ছেলে তাই করেছে। চোখের সামনে পাঁচ টাকার একটা কয়েন অদৃশ্য করেছে। কোটের হাতায় লুকিয়ে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। কোটের হাতা সে গুটিয়ে নিয়েছে। একটা বস্তু হঠাৎ অদৃশ্য হতে পারে না। Volatile কোনো বস্তু অদৃশ্য হলে বলা যেত যে হাতের মুঠোর উত্তাপে বস্তুটা বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। পাঁচ টাকার কয়েন কোনো ভলাটাইল বস্তু না।
আশহাব বলল, স্যার, আপনার মনে হয় ম্যাজিকটা খুব পছন্দ হয়েছে।
রশীদ সাহেব বললেন, পছন্দ হবার কিছু না। এটা নতুন কেনা শার্ট না যে পছন্দ হবে। আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। কেন বিভ্রান্ত হয়েছি এটা বের করতে হবে। আমি অল্প বুদ্ধির মানুষ না যে যাই দেখব তাতেই বিভ্রান্ত হব।
অতিবুদ্ধিমানরাই সহজে বিভ্রান্ত হয়।
Don’t talk nonsense.
আশহাব চুপ করে গেল। বৃদ্ধের হতচকিত অবস্থাটায় সে খুবই মজা পাচ্ছে। কাউকে ম্যাজিক দেখিয়ে এত আরাম এর আগে সে পায়নি।