মা বললেন, কক্সবাজার সি বিচে চোরাবালি আছে। অনেকে চোরাবালিতে ড়ুবে মারা গেছে।
বাবা বললেন, সমুদ্রে নামব না।
মা বললেন, বাদ। বাদ। সমুদ্র বাদ। চল সিলেটে যাই। জাফলং সুন্দর জায়গা। সিমিরা জাফলং গিয়েছিল। ছবি তুলে এনেছে। দেখার মতো জায়গা। সেখান থেকে ইন্ডিয়া দেখা যায়।
বাবা বললেন, ইন্ডিয়া দেখার দরকার কি?
মা বললেন, সমুদ্র দেখারইবা দরকার কি? চোখ বন্ধ করে ঘরে বসে থাক।
আমাদের সমুদ্র দেখার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল। বাবা মারা গেলেন সেই বছরই। চিত্রা, আমি যদি একটা সিগারেট ধরাই আপনি কিছু মনে করবেন?
আমি কিছু মনে করব না।
আশহাব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মা দুই টিফিন কেরিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছেন। খাবারের প্রতিটি আইটেম আমাকে খেতে হবে। ভালো লাগুক বা না লাগুক, খেতে হবে। খাওয়া নিয়ে আরো ব্যাপার আছে।
আর কি ব্যাপার?
খাবারের প্রথম নলাটা মা আমার মুখে তুলে দেবেন। এতে নাকি ছেলেমেয়ের হায়াত বাড়ে। দৃশ্যটা চিন্তা করে দেখুন—আমি চোখ বন্ধ করে হা করে আছি মা মুখে ভাতের প্রথম নলা তুলে দিচ্ছেন।
চিত্রার হাসি আসছে সে হাসি চাপতে চাপতে বলল, চোখ বন্ধ করে হা করে থাকবেন কেন? চোখ ভোলা রাখবেন।
চোখ খোলা রেখে সেই সময় মায়ের মুখ দেখব? নো।
আশহাব সিগারেটে লম্বা টান দিল। ঠিক তখন এটেনডেন্ট বসির বলল, স্যার, আপনাকে আপনার মা ডাকেন। আশহাব চমকে উঠে সিগারেট জানালা দিয়ে ফেলে দিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। বসিরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি মাকে বলুন আমি এখন আসতে পারব না। একটু দেরি হবে।
বসির চলে যেতেই আশহাব বিব্রত গলায় বলল, মাকে কেমন ভয় পাই দেখেছেন? মার কথা শুনেই লাফ দিয়ে উঠেছি।
চিত্রা বলল, দেখলাম।
খুবই খারাপ লাগছে।
মাকে ভয় পাওয়ার মধ্যে খারাপ লাগার কিছু নেই। আপনি যান তার সঙ্গে দেখা করে আসুন।
আশহাব উঠে দাঁড়াল। সে দ্রুত যাচ্ছে। চিত্রার মনে হল—এই মানুষটার বর্তমান চেষ্টা এটেনডেন্ট মার কাছে পৌঁছানোর আগেই পৌঁছানো। যেন
মহিলাকে শুনতে না হয়, আমি এখন আসতে পারব না।
সাজেদা বেগম ছেলেকে দেখেই বললেন, আমাকে একা ফেলে রেখে কোথায় ঘুরঘুর করছিস?
আশহাব জবাব দিল না।
সাজেদা বললেন, ঐ মেয়েটা কোথায়?
কোন মেয়েটা?
রাতে আমার সঙ্গে থাকবে যে মেয়েটা। চিত্রা নাম।
আশহাব বলল, জানি না কোথায়।
সাজেদা অবাক হয়ে বললেন, মিথ্যা কথা বলছিস কেন? এটেনডেন্ট আমাকে বলল, তুই মেয়েটার সঙ্গে গল্প করছিলি। তুই বলে পাঠিয়েছিস আসতে পারবি না। ঘটনা কি? ঐ মেয়ের সঙ্গে তোর কি? তুই কি ঐ মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছিস?
দশ মিনিট কথা বললে প্রেমে পড়ে যায়?
তাহলে মিথ্যা কথা বললি কেন? কেন বললি, মেয়ে কোথায় তুই জানিস না। মুখ ভোতা করে থাকবি না। বল ঐ মেয়ের সঙ্গে তোর কি? তোর গা থেকে ভুরভুর করে সিগারেটের গন্ধ আসছে। তুই কি সিগারেট খেয়েছিস? কাছে আয়, মুখ শুকে দেখি।
আশহাব বলল, মুখ শুকতে হবে না মা। আমি সিগারেট খেয়েছি। আজই যে প্রথম খাচ্ছি তা-না, প্রায়ই খাই।
কি বললি, প্রায়ই খাস?
হ্যাঁ খাই।
সাজেদা বললেন, তোর ভাব-ভঙ্গি তো মোটেই ভালো মনে হচ্ছে না। এখন তো আমার মনে হচ্ছে তুই সুযোগ পেলে মদও খাস। আমার গা ছুঁয়ে বল তুই মদ খাস কি খাস না।
মা, আমি কয়েকবার খেয়েছি।
হতভম্ব সাজেদা নিজেকে সামলে নিয়ে চাপা গলায় বললেন, তোর বাবা একবার বন্ধুর বাসা থেকে মদ খেয়ে এসেছিল। তাঁকে কি করেছিলাম মনে আছে?
আশহাব বলল, মনে আছে। আমি যতদিন বাঁচব ততদিন মনে থাকবে। যে অন্যায় সে রাতে তুমি করেছ তার কোনো তুলনা নেই।
সাজেদা হতভম্ব গলায় বললেন, তুই আমার অন্যায়টা শুধু দেখলি। তোর বাপের অন্যায়টা দেখলি না? বন্ধুর বাসা থেকে মদ খেয়ে এসে আমাকে বলেছে জিরা-পানি খেয়েছে। তার মুখে না-কি জিরার গন্ধ। আমাকে জিরা চেনায়। আমি জিরার গন্ধ চিনি না? আমি মশলা ছাড়া রাধি?
আশহাব কামরা থেকে বের হল। মার একটানা কথা শুনতে অসহ্য লাগছে। মা কথা বলতেই থাকবেন, বলতেই থাকবেন। এক সময় কাঁদতে শুরু করবেন। আশহাব করিডোরে এসেই সিগারেট ধরাল। সিগারেটে টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল মার সঙ্গে এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলত। সমস্যার সমাধান অবশ্যি দ্রুত করা যাবে। মার সামনে বসে বললেই হবে, মা! মুখে ভাত তুলে দাও। এই কাজটা সে কি এক্ষুনি করবে? না-কি কিছু সময় নেবে? খুক খুক কাশির শব্দে আশহাব তাকালো।
বুড়ো ভদ্রলোক কাশছেন।
দরজার পাশে প্লাস্টিকের চেয়ারে রশীদ সাহেব বসে আছেন। হাতে কাগজ কলম। হিসাব নিকাশ হচ্ছে। এই বুড়োর সঙ্গে রাত কাটাতে হবে। আগেই পরিচয় করে নেয়া ভালো হবে। যদি তেমন অসহনীয় হয় তাহলে বুফে কারে বসে থাকাটাও খারাপ না। আশহাব এগিয়ে গেল। বুড়োর সঙ্গে রাত কাটাবার একটা সুবিধা আছে। বুড়ো সিগারেট খায়। এত দূর থেকেও তার গা থেকে নিকোটিনের কড়া গন্ধ আসছে।
রশীদ সাহেব খাতায় কিছু হিসাব নিকাশ করছেন। এই মুহূর্তে তার হাতে সিগারেটের বদলে কলম। সিগারেট বিপদজনকভাবে ঠোঁটে ঝুলে আছে। যে কোনো মুহূর্তে ঠোঁট থেকে খসে পড়তে পারে। বৃদ্ধের নজর হাতের কাগজে। বসির নামের এটেনডেন্ট তাঁকে ট্রেনযাত্রীর পুরো সংখ্যা দিয়েছে।
ফুল টিকেট যাত্রী ৬২২ জন।
হাফ টিকেট যাত্রী ১৮ জন।