মহিলা বললেন, মা আমি ব্যবস্থা করছি। একটা হেলিকপ্টার আনার ব্যবস্থা করছি। এই জায়গার ঠিক লোকেশন দরকার। রেলের কাউকে খবর দিয়ে আনতে পারবে? যার মাধ্যমে ঠিক ঠিক লোকেশনটা আমি জানতে পারি?
হতভম্ব চিত্রা বলল, আপনি কিভাবে হেলিকপ্টার আনবেন? আপনার পরিচয় জানতে পারি?
মহিলা বললেন, আমার একটাই পরিচয়। আমি একজন দুঃখী মা। ছেলের ডেডবডি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি। আমার একটাই ছেলে। ছেলের বাবা মারা গেছেন দশ বছর আগে। সময় নষ্ট করে লাভ নেই তুমি রেলের কোনো একজনকে ডাক।
.
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার রওনা হয়েছে। দু’জন মাত্র যেতে পারবে। রোগীর সঙ্গে যাচ্ছে তার ছেলে এবং আশহাবের মা সাজেদা বেগম। তিনি চিত্রাকে ডেকে কঠিন ভঙ্গিতে বলেছেন–বৌমা আমার ছেলেকে তোমার হাতে রেখে গেলাম। চোখে চোখে রাখবে। সুযোগ পেলেই যেন চুকচুক করে কিছু না খায়। এতদিন আমি দেখেছি। এখন তুমি বাড়ির বৌ তুমি দেখবে।
রশীদ উদ্দিন পাশেই ছিলেন। তিনি চমকে উঠে বললেন, তোমরা এই ফাঁকে বিয়েও করে ফেলেছ। আশ্চর্য তো!
সাজেদা বিরক্ত হয়ে বললেন, আশ্চর্য হবার কি আছে? বয়স হয়েছে বিয়ে করবে না? ধেং ধেং করে প্রেম করে বেড়াবে? কৃষ্ণ লীলা আমার পছন্দ না। আমি প্রেম করার বিপক্ষে। প্রেম যদি করতেই হয়–বিয়ের পরে করা উচিত। সবচে ভাল হয় না করলে।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার কথাবার্তা আমার অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। আপনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হওয়া অতীব জরুরি।
সাজেদা আঁচল তুলে ঘোমটা দিতে দিতে চিত্রাকে বললেন, বৌমা। বুড়াটাকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো। বেলাজ বুড়া।
.
মন্ত্রী সাহেবের আত্মীয়স্বজন চলে এসেছেন। তারা সেলুন কারে উঠেছেন।
ট্রেনের ইনজিন ঠিক হয়ে গেছে। এক্ষুনি ট্রেন ছাড়বে। যাত্রীরা হেলিকপ্টারের চারদিকে ভীড় করে আছে বলে ট্রেন ছাড়া যাচ্ছে না।
হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করেছে। যাত্রীরা বিকট শ্লোগান দিল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবুল খায়ের! জিন্দাবাদ’। তারা ধরেই নিয়েছে এই কাজটা মন্ত্রী সাহেব থাকাতেই সম্ভব হয়েছে।
সুরমা তার বোন এবং ভগ্নিপতির সঙ্গে হাত-পা নাড়িয়ে গল্প করছেন– তোর দুলাভাইয়ের মানুষের প্রতি মমতাটা কি রকম দেখলি। চিনে না, জানে
একজনের জন্যে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছে। তার যত মমতা পাবলিকের জন্যে নিজের ফ্যামিলির দিকে সে ফিরেও তাকায় না।
যমুনা বলল, আপা তুমি দুলাভাইকে একটা বক্সিং দাও।
সুরমা বললেন, আমি পারব না। তুই দিয়ে আয়।
যমুনা উঠে গেল। খায়ের সাহেবের পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, দুলাভাই! আপনি এত ভাল কেন?
.
কিছুক্ষণের গল্প শেষ। পাঠকদের সামান্য কৌতূহল থাকতে পারে চিত্রা এবং আশহাবের কি হল। ওরা কি বিয়ে করেছে? না-কি যে যার পথে গিয়েছে। অংকবিদ রশীদ উদ্দিনেরই বা কি হল?
রশীদ উদ্দিনের কি হল বলতে পারছি না। উনি পোটলা পুটলি নিয়ে ভুল এক স্টেশনে নেমে পড়েছেন। তার পিছনে পিছনে কি মনে করে জানি মাওলানাও নেমে পড়েছেন।
চিত্রা সাজেদা বেগমের কামরায় ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। গভীর রাতে বাতি-টাতি নিভিয়ে সে ফিস ফিস করে লিলিকে টেলিফোন করল–
এই লিলি হ্যালো। একটা গোপন কথা শুনবি?
অবশ্যই শুনব।
আমি একজনের প্রেমে পড়েছি।
বলিস কি?
অনেকক্ষণ তাকে দেখতে পাচ্ছি না, দুঃখে-কষ্টে আমার মন ভেঙে যাচ্ছে।
লোকটা কে?
ডাক্তার। আশহাব নাম।
উনি কোথায়?
আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
লিলি বলল, গাধামী করবি না। এক্ষুনি দরজা খুলে তাকে ভেতরে ডেকে নে।
কি অজুহাতে ডাকব?
যে কোনো অজুহাতে ডাকবি। মেয়েদের অজুহাতের অভাব আছে নাকি? চিত্রা দরজা খুলে বলল, আমার ক্ষিধে লেগেছে। খাব। খাবারগুলি গরম করে আনার ব্যবস্থা করো তো। চিত্রা মানুষটাকে তুমি তুমি করে বলছে তার মোটেও খারাপ লাগছে না। তার মাথায় একটা দুষ্টামিও ঢুকেছে। সে ঠিক করেছে খাবার সময় আশহাবকে চমকে দিয়ে বলবে, আমি হা করছি আমাকে খাইয়ে দাও।
.
ট্রেন অন্ধকারে ছুটে চলছে। সেলুন কারে গান হচ্ছে–আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। ট্রেনের যাত্রা কি জোছনা স্নাত কোনো অলৌকিক বনের দিকে?