রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনি অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আপনার পক্ষে এই অবস্থাতেও ব্যবস্থা করা সম্ভব।
খায়ের সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি একটা ভুল করছেন– মন্ত্রীদের হাতে আলাদিনের চেরাগ থাকে না। চেরাগ ঘসে তারা দৈত্য আনতে পারে না। যদি চেরাগ থাকতো আমি চেরাগের দৈত্যকে বলতাম সে ম্যাজিক কার্পেটে করে রোগী সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে নিয়ে চিকিৎসা করাতে।
রশীদ উদ্দিন সহজ গলায় বললেন, স্যার আপনার কাছে ম্যাজিক কার্পেট আছে।
আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?
জি-না। আমি অংকের শিক্ষক। অংকের শিক্ষকরা রসিকতা বুঝতেও পারে না। করতেও পারে না।
রশীদ উদ্দিন দ্বিতীয়বার চমকালেন। আক্কাস মাস্টারও অংকের শিক্ষক ছিলেন। খায়ের সাহেব বললেন, আপনার রোগীর প্রতি আমি যথেষ্ট সিমপ্যাথি বোধ করছি কিন্তু বুঝতেই পারছেন আমার কিছু করার নেই।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনি টেলিফোন করেই একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে পারেন। দশ মিনিটে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার চলে আসবে। মহিলার জীবন রক্ষা হবে। আমি কি আমাদের পবিত্র গ্রন্থ থেকে একটা আয়াত বলব?
খায়ের সাহেব চুপ করে রইলেন। রশীদ উদ্দিন বললেন, আল্লাহপাক বলছেন, যে একটি জীবন রক্ষা করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই রক্ষা করে আর যে একটি জীবন নষ্ট করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই ধ্বংস করে।
খায়ের সাহেব পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আমি ঢাকায় আমার বাড়ির ছাদে তিনটা হেলিকপ্টার রেখে দিয়েছি। টেলিফোন করব আর উড়ে চলে আসবে।
তার মানে কিছু করতে পারছেন না?
না।
দু-এক জায়গায় টেলিফোন করে দেখেন কাজ হতেও তো পারে। সিচুয়েশনটা চিন্তা করুন বনের মধ্যে ট্রেন আটকে আছে। একজন মৃত্যুপথযাত্রী। ট্রেনের এক যাত্রী মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ঘটনা শুনে মর্মাহত হলেন। নানান ঝামেলা করে হেলিকপ্টার আনালেন। রোগী ঢাকা পাঠানো হল। হেলিকপ্টার যখন উড়তে শুরু করবে তখন ট্রেনের শত শত যাত্রী চিৎকার করে বলবে–আবুল খায়ের খান, জিন্দাবাদ। তারা মন থেকে বলবে। তাদেরকে ভাড়া করে আনতে হয়নি। নিজের পকেট থেকে একটা পয়সা খরচ না করেও আপনি স্বতস্ফূর্ত জিন্দাবাদ ধ্বনি শুনবেন।
আবুল খায়ের বললেন, আপনি কি বিদায় হবেন?
রশীদ উদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আপনাকে কুৎসিত একটা গালি দিতে ইচ্ছা করছে। যে গালি শুনলে আপনার পিত্তি জ্বলে যাবে এ রকম গালি। তা না দিয়ে একটা ভদ্র গালি দিচ্ছি। হাজার হলেও আপনি মন্ত্রী মানুষ–তুই গু খা। ফ্রেস গু না, তিন দিনের বাসি গু। যার উপর নীল রঙের মোটা মোটা মাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়ছে। মন্ত্রীকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে রশীদ উদ্দিন বের হয়ে গেলেন।
.
এতক্ষণ খায়ের সাহেব সিগারেট হাতে বসেছিলেন এখন সিগারেট ধরালেন। তার ভুরু কুচকে আছে। টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। ধরবেন না, ধরবেন না করেও তিনি টেলিফোন ধরলেন। তাঁর স্ত্রী টেলিফোন করেছে।
সুরমা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, হ্যালো। হ্যালো।
হুঁ।
এতবড় একটা ঘটনা। তুমি আমাকে কিছুই জানাও নি। আমি খবরটা শোনার পরেই জঙ্গলের মধ্যে দুই রাকাত শুকরানা নামাজ পড়েছি। একটা ছাগল সদকা মানত করেছি। ময়মনসিংহ পৌঁছেই ছাগল দিয়ে দিব।
ভাল।
এই শোনো রেলমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি নিজেই টেলিফোন করেছিলেন। আমরা জঙ্গলে পড়ে আছি শুনে উনি হতভম্ব। যাই হোক ব্যবস্থা করেছেন। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।
খায়ের সাহেব বললেন, কি ভাবে?
তোমাদের ট্রেন আটকে বসে আছে না?
হ্যাঁ। ইনজিন নষ্ট।
ইনজিন নষ্ট তোমাকে কে বলেছে? ইনজিন ঠিকই আছে। রেলমন্ত্রীর নির্দেশে ট্রেন আটকা। আমাদেরকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এক বগির একটা ট্রেন তোমাদের কাছে যাবে। আমরা সেলুনে উঠব তারপর ট্রেন ছাড়বে।
ও আচ্ছা।
তোমার কথাবার্তায় প্রাণ নেই কেন বল তো? এদিকে আমরা খুব হৈ চৈ করছি। জঙ্গলের মধ্যেই কনসার্ট। কি যে মজা হয়েছে। যমুনা এবং যমুনার স্বামী সাম্বা নাচ নেচেছে। ওরা যে সাম্বা নাচতে জানে আমার ধারণাই ছিল না। সেলুন কারে পৌঁছানোর পর ঐ নাচটা আবার করতে বলব।
আচ্ছা।
আমি আর কি ঠিক করেছি জান, এক রাতে জঙ্গলে প্রোগ্রাম করব। তোমার সব বন্ধু-বান্ধবরা থাকবে। জোছনা রাত। রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হবে। ঐ যে উনার বিখ্যাত গান–’আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।‘
হুঁ।
.
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চিত্রা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। চোখের সামনে একটা মেয়ে মরে যাচ্ছে এই দৃশ্যটা সে নিতেই পারছে না। মাওলানার স্ত্রী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে। ছেলেও ড্যাব ড্যাব করে মা’কে দেখছে। কি অদ্ভুত এবং কি করুণ এক দৃশ্য। এই দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করা মুশকিল। চিত্রা বের হয়ে চলে এসেছে।
বাথরুমের পাশের ঘরের দরজা খুলল। একজন ভদ্রমহিলা এসে চিত্রার পাশে দাঁড়ালেন। চিত্রাকে চমকে দিয়ে তার পিঠে হাত রাখলেন। নরম গলায় বললেন, মাগো! আমি খবর পেয়েছি মেয়েটা মারা যাচ্ছে। কেঁদে কি আর মৃত্যু ফেরানো যায়।
চিত্রা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, মৃত্যু ফেরাবার জন্যে কাঁদছিনা। কষ্টে কাঁদছি। এক ঘণ্টা সময় হাতে পেলেও মৃত্যু ফেরানো যেত।