আক্কাস মাস্টারের শুধু যে চাকরি গেল তা-না, অন্যদের নামে বিশেষ করে স্কুল কমিটির সেক্রেটারি রজব মিয়ার নামে মিথ্যা অভিযোগ আনার শাস্তিও হল। আক্কাস মাস্টারকে কানে ধরে রজব মিয়ার বাড়ির সামনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। তার পাঞ্জাবীর বুকে সেফটি পিন দিয়ে একটা কাগজ লাগিয়ে দেয়া হল। সেখানে লেখা
“আমি চোর”
আক্কাস মাস্টার কাঁদছিল। তাকে কাঁদতে দেখে বালক খায়েরের হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল। সে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। তার বাবা এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, বাবা কি হইছে? কান্দ কেন? সে কিছুই বলে না শুধু কাঁদে। তার মা তখন বললেন, আক্কাস মাস্টার কানে ধইরা কানতেছে এইটা দেইখা তোমার পুলা কানতেছে।
খায়েরের বাবা অতি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার পুলার অন্তরে এত মায়া? এত মায়া আমার পুলার অন্তরে! তিনি তৎক্ষণাৎ হাত তুলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহপাক আমার ছেলের অন্তরের এই মায়া যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকে। আমিন।
খায়েরের যখন আট বৎসর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। আজ তার বয়স ৫৯-এর কিছু বেশি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর আজ তার বাবার কথা মনে পড়ল এবং চোখে পানি এসে পড়ল। তার পরহেজগার বাবার প্রার্থনা আল্লাহপাক শোনেন নি। শৈশবের মায়ার কিছুমাত্র তার মধ্যে নেই। তিনি এই সমাজে অতি দুষ্ট মানুষ হিসেবে পরিচিতি।
.
ট্রেন থেমে পড়েছে। স্টেশন ছাড়াই থেমেছে। দু’দিকে শালবন। নিঝুম এক জায়গা। জানা গেছে ইনজিনে কি এক ঝামেলা হয়েছে। ড্রাইভার ইনজিন সারাবার চেষ্টা করছে। কিছু যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। অনেকে ভীড় করেছে ইনজিনের পাশে।
.
মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা ভাল না। প্লেসেন্টা এখনো বের হয়নি। অস্বাভাবিক রক্তপাত হচ্ছে। এই মহিলাকে অতি দ্রুত হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। জঙ্গলে ট্রেন থেমে থাকলে গুরুতর সমস্যা হবে। মাওলানা সমস্যার ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। পুত্র লাভ উপলক্ষে তিনি শোকরানা নামাজ শেষ করেছেন। আনন্দিত মুখে বার বার তার কামরায় উঁকি দিচ্ছেন। বাচ্চা কোলে নিয়ে সাজেদা বেগম বসে আছেন। সমস্যার জটিলতা তিনি বুঝতে পারছেন। একটু পর পর তিনি চিত্রাকে বলছেন, বৌমা খোঁজ নাও ট্রেন কখন ছাড়বে। কামরায় আশহাব আছে। সে ক্ষণে ক্ষণে মার কাছ থেকে ধমক খাচ্ছে–তুই তো গাধা ডাক্তার। কিছু করতে পারছিস না এটা কেমন কথা। তুই কি নকল করে পাস করেছিস যে কিছু জানিস না। গাধার গাধা। তোর বাপ ছিল গাধা। তুইও গাধা!
এমন কঠিন সময়ে মাওলানা উঁকি দিল এবং সবগুলি দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করল, খালাম্মা ছেলে কি আমার মতো হয়েছে?
সাজেদা বললেন, ছেলের গালে ছাগলা দাড়ি নাই। ছেলে তোমার মতো হয় নাই। ছেলে কার মতো হয়েছে এই চিন্তা বাদ দাও। তোমার বৌকে বাঁচাবার চেষ্টা কর।
মাওলানা বললেন, কঠিন দোয়ার মধ্যে আছি খালাম্মা। দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যে ইনজিন ঠিক হবে ইনশাল্লাহ। আমরা একটানে ময়মনসিংহ পৌঁছে যাব।
সাজেদা বললেন, আল্লাহপাক কি ইনজিন ঠিক করার জন্যে ফেরেশতা পাঠায়েছেন?
মাওলানা বললেন, এই ধরনের কথা বলবেন না খালাম্মা। বিরাট পাপ হবে। এইসব খোদা নারাজি কথা।
খোদা তোমার আমার মতো না। এত্ত সহজে তিনি নারাজ হন না। তুমি আমার সামনে থেকে যাও। তুমি হচ্ছ রামছাগল। ট্রেন থেকে নেমে দেখ কাঁঠাল গাছ পও কি-না। যদি পাও পাতা ছিঁড়ে পাতা খাও।
.
ড্রাইভার সাহেব বলেছেন, ইনজিনের মূল পিস্টন ভেঙে গেছে। উদ্ধারকারী ইনজিন না এলে কিছু করা যাবে না। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। রশীদ উদ্দিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন। তাঁর সামনে আশহাব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
রশীদ উদ্দিন বললেন, মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা কি? সে কি চার-পাঁচ ঘন্টা সারভাইভ করবে?
আশহাব বলল না, আমাদের হাতে বড় জোর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে।
রশীদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন।
আশহাব বলল, স্যার কোথায় যান।
রশীদ উদ্দিন জবাব দিলেন না।
.
আবুল খায়ের সাহেব সেলুন কারের সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। তাঁর কামরায় বৃদ্ধ যে মানুষটা ঢুকছে তার চেহারা অবিকল আক্কাস মাস্টারের মতো। অথচ আক্কাস মাস্টার চার বছর আগে মারা গেছেন। তিনি নিজে তার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।
সেই লুঙ্গি পরা মানুষ। মাথায় মাফলার। আক্কাস মাস্টারেরও একই ব্যাপার ছিল। লুঙ্গি, শীত-গ্রীষ্মে মাফলার। খায়ের সাহেব উঠে দাঁড়াবেন না কি বসেই থাকবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি এক ধরনের অস্বস্থির মধ্যে পড়ে গেলেন।
আমার নাম রশীদ উদ্দিন। আমি আপনার কাছে একটি আবেদন নিয়ে এসেছি।
খায়ের সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি আবেদন
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার সামনে বসে বলি। আমাকে দুই মিনিট সময় যদি দেন।
বসুন।
রশীদ উদ্দিন বললেন, ট্রেনের একজন যাত্রী মহা বিপদে পড়েছে। তার একটি সন্তান হয়েছে। এখন শুনতে পাচ্ছি প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। তাকে অতি দ্রুত কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার। আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন তাহলে মেয়েটি বেঁচে যায়।
খায়ের সাহেব বললেন, আমি কি ভাবে ব্যবস্থা করব? ইনজিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কখন ঠিক হবে তার নেই ঠিক।