.
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সেলুন কারে বাতি এসেছে। আবুল খায়ের সাহেব একা বসে আছেন। তাকে ফেলে সবাই নেমে গেছে এই ধাক্কা থেকে তিনি এখনো মুক্ত হতে পারছেন না। তিনি সিগারেট ধরিয়েছেন। গলার টক ভাবটা চলে গেছে। সিগারেট টানতে তার খারাপ লাগছে না। ব্লাডি মেরি একটা খেলে মন্দ হত না।
স্যার!
আবুল খায়ের চমকে তাকালেন। তার পেছনে সবুর দাঁড়িয়ে। যার কানে ধরে উঠবোস করাতেই নাটকের শুরু।
স্যার সবাই কই?
নেমে গেছে।
কই নেমে গেছে?
জঙ্গলে।
কেন স্যার?
খায়ের সাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোমরা একজনকে মেরে আধমরা করেছ, নেংটো করে পাঠিয়েছ এতে সবাই গেছে ভড়কে।
সবুর দুঃখিত গলায় বলল, কাজটা ঘটেছে মূসা ভাইয়ের কারণে। উনি ইউনিয়ন সেক্রেটারি। আমি উনার হাতে পায়ে ধরতে বাকি রাখছি।
মূসা সাহেবের এখনকার পরিকল্পনা কি?
কোনো পরিকল্পনা নাই স্যার। মূসা ভাই আপনার সঙ্গে দেখা করবে। ক্ষমা চাবে। তাকে নিয়ে আসি স্যার? আপনাকে চা দেব। চা খাবেন?
খাব।
ডিনার কখন দেব স্যার?
ভেবে দেখি।
খায়ের সাহেবের মোবাইল টেলিফোন বাজছে। সুরমা টেলিফোন করেছেন। মোবাইল বিপ্লবের ফসল। জঙ্গল থেকেও কথা বলা যাচ্ছে।
সুরমা বললেন, এই আমার মনে হয় পা ভেঙে গেছে। ট্রেন থেকে যখন পুলিশ আমাদের উপর গুলি করল তখন দৌড় দিতে গিয়ে খাদে পড়ে গেছি। এখন পা নড়াতে পারছি না।
সরি টু হিয়ার দ্যাট।
বার হাজার টাকা দামের শাড়ি। ছিঁড়ে কুটি কুটি।
সরি টু হিয়ার দ্যাট।
তোমার অবস্থা কি?
এখনো বেঁচে আছি। রাখি কেমন?
রাখি রাখি করছ কেন?
রাখি রাখি করছি কারণ মূসা সাহেবের সঙ্গে আমার এপয়েন্টমেন্ট। উনি যে কোনো সময় চলে আসবেন।
মূসা সাহেব কে?
আমাদের শাস্তি দেয়ার মূল পরিকল্পনা উনার। উনি রেল ইউনিয়নের লোক।
কি সর্বনাশ!
খায়ের সাহেব লাইন কেটে দিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার কাছে অতি জরুরি একটা টেলিফোন এল। তাঁকে জানানো হল মন্ত্রীত্ব চলে যাওয়া বিষয়ে যে কথা প্রাইম মিনিস্টারের অফিসের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে তা পুরোপুরিই গুজব। এ ধরনের গুজব রটনায় প্রাইম মিনিস্টার নিজে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। গুজবের পেছনে কারা আছে বের করতে বলেছেন। প্রাইম মিনিস্টার নিজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন।
আবুল খায়ের সাহেবের চা চলে এসেছে। তিনি চায়ে চুমুক দেয়া মাত্র প্রাইম মিনিস্টারের টেলিফোন এল। তিনি তিন চার মিনিট কথা বললেন।
সবুর বিনয়ী ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। টেলিফোন শেষ হওয়া মাত্র বলল, স্যার মূসা ভাইকে কি আনব?
এখন না।
চা কেমন হয়েছে স্যার?
চা ভালো হয়েছে। তুমি সামনে থেকে যাও। আমি কিছুক্ষণ একা থাকব।
সবুর চলে গেল। আবুল খায়ের টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি নিশ্চিত অন্ধকার কেটে গেছে এখন একের পর এক টেলিফোন আসতে থাকবে। সবার আগে রেলমন্ত্রীর টেলিফোন আসার কথা। এত দেরি হচ্ছে কেন?
টেলিফোন বাজছে। মন্ত্রী মহোদয় টেলিফোন ধরলেন না। কারণ সুরমা টেলিফোন করেছে। সুরমা’র টেলিফোন ধরার কিছু নেই। এখন হয়ত জানা যাবে যে সে এক পাটি স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি বিড় বিড় করে বললেন, I have no business with you.
.
রেল মন্ত্রী না, প্রথম টেলিফোন করলেন পূর্ত প্রতিমন্ত্রী হেলালউদ্দিন, তাঁর গলায় আনন্দ।
খায়ের ভাই।
হুঁ।
মাঝখানে মোবাইল অফ রেখেছিলেন? কল করি লাইন যায় না।
অফ থাকতে পারে।
আরে গ্রেট খায়ের ভাই! আপনার ব্যাপারটা তো পুরো রিউমার। খবর পেয়েছেন না?
হুঁ।
একটা সোর্স থেকে খবর পেলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছে।
হুঁ।
মাঝখানে রেলের একটা হাঙ্গামা হয়ে গেল। এই নিয়ে তোলপাড় হয়ে গেছে–আমি স্ট্রংলি কয়েকজনকে ধরেছি।
হেলাল রাখি? আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।
সে কি! কি হয়েছে? আপনি এত কাজ করেন শরীর খারাপ হবারই কথা। ভাবী আছে ভাবীকে দিন। ভাবীর সঙ্গে কথা বলি।
‘তোমার ভাবী একটু ব্যস্ত আছেন।’ বলেই খায়ের সাহেব টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেন। তিনি বসেছেন জানালার পাশে। ট্রেনের চাকায় ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। জানালার ও পাশের বন জঙ্গল ঘরবাড়ি দ্রুত সরে যাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। সবচে ভাল লাগছে অনেক দূরের বাড়িঘরের হারিকেন বা কূপীর আলো। ছোটবেলায় এইসব আলো দেখতে ভয় ভয় লাগতো। তাকে কে যেন বলেছিল ঐগুলা জ্বীনের চোখ। জ্বীন কখনো তাকিয়ে থাকে, কখনো চোখ বন্ধ করে। এই জন্যেই দূরের আলো কখনো দেখা যায় কখনো দেখা যায় না।
খায়ের সাহেবের মনে হল ট্রেনে করে তিনি উল্টা যাত্রা শুরু করেছেন। ট্রেন অতি দ্রুত তাকে শৈশবে নিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে একজন লজিং মাস্টার থাকতেন। নাম আক্কাস। আক্কাস স্যার তাকে অংক আর ইংরেজি শেখাতেন। অংক এবং ইংরেজির বাইরে আরেকটা জিনিস শেখাতেন। তিনি সেই শিক্ষার নাম দিয়েছিলেন সত্য শিক্ষা।
মিথ্যা কথা মানুষ কি জন্যে বলে জানিস?
জি না।
মিথ্যা কথা বলতে আরাম এই জন্যে মানুষ মিথ্যা কথা বলে। সত্যি কথা বলতে বেআরাম।
বেআরাম কেন?
জানি না কেন। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। মিথ্যা কথা হুট করে মুখ দিয়ে বের হয়। সত্যিটা বের হয় না। আজিব ব্যাপার।
তাদের এই লজিং স্যার পরে স্কুলেই চাকরি পান। সত্যি কথা বলার বদঅভ্যাসের কারণে তার চাকরি চলে যায়। সেবার স্কুলের উন্নয়নের জন্যে একশো বস্তা গম বরাদ্দ হয়েছিল। হেডমাস্টার সাহেব নিজে দশ বস্তা রেখে অন্য সব শিক্ষকদের দুই বস্তা করে দিলেন। স্কুল কমিটির সেক্রেটারি পেলেন পাঁচ বস্তা। গভর্নিং বডির মেম্বাররা তিন বস্তা করে। একজন শুধু গম নিলেন না, তার নাম আক্কাস মাস্টার। তিনি শুধু যে গম নিলেন না, তা-না জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানালেন। তদন্ত হল। তদন্তে প্রমাণিত হল আক্কাস আলি স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান নষ্ট করার জন্যে এই কাজ করেছেন। নিজে সাধু সেজে অন্যদের চোর বানাতে চেয়েছেন।