আবুল খায়ের বললেন, আমারো ভাল মনে হচ্ছে না।
হেলাল উদ্দিন বললেন, আপনাদেরটা কি সব শেষের কামরা?
হ্যাঁ।
বলেন কি। আরো বিপদ।
আরো বিপদ কেন?
হেলাল উদ্দিন বললেন, বদগুলা বগিটা খুলে দিতে পারে। মূল ট্রেন থেকে আলাদা করে দিতে পারে। পরে যখন ইনভেসটিগেসন হবে তখন বলবে একসিডেন্ট। আপনা আপনি খুলে গেছে।
তুমি তো আরো ভয় ধরিয়ে দিলে।
খায়ের ভাই এটাই বাস্তবতা।
এখন করব কি বল।
ঐ পার্টির কাউকে টাকা পয়সা দিয়ে হাত করতে হবে। বিপদ থেকে উদ্ধারের একটাই পথ।
তুমি রেলের কাউকে কিছু বলতে পার না?
আচ্ছা দেখি। কি করতে পারি আপনাকে জানাব।
দশ মিনিট পর আমি টেলিফোন করি?
হেলাল উদ্দিন বললেন, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি জানাব।
আবুল খায়ের সাহেব চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি নিশ্চিত হেলাল উদ্দিন আর টেলিফোন করবে না। নিজের মোবাইলও অফ করে রেখে দেবে। হেলালকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তিনি নিজে অসংখ্যবার এই কাজ করেছেন। অন্যদের করতে দোষ কি? মহা বিপদে পড়ে কতবার লোকজন তাকে টেলিফোন করেছে তিনি বলেছেন, দেখি কি করা যায়। কিছু করতে পারলে জানাব আমাকে টেলিফোন করার দরকার নেই। বলেই লাইন কেটে দিয়েছেন।
ব্যান্ডদলের পরিচালকের নাম কাউসার। সে নিজের নাম লেখে ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে–Cowসার। নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে বলে গরুর সার অর্থাৎ গোবর। Cowসার ডাকতে যদি সমস্যা হয় আমাকে গোবর ডাকতে পারেন, গোবর ভাইয়া ডাকতে পারেন কোনো অসুবিধা নেই।
কাউসারের রসবোধে তার ব্যান্ডের লোক যেমন মোহিত, বাইরের লোকজনও মোহিত। এই মুহূর্তে তার মধ্যে রসবোধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সে ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছে। টেনশানে তার পেট নেমে গেছে। কাউসার আবুল খায়েরের দিকে এগিয়ে এল। খায়ের সাহেব বললেন, কিছু বলবে?
কাউসার বলল, বিনাকারণে আমরা ক্যাচালের মধ্যে পড়েছি। আমরা ঠিক করেছি সামনের স্টেশনে নেমে যাব। সঙ্গে অনেক টাকার ইনস্ট্রমেন্ট। নষ্ট হলে পথে বসব।
খায়ের সাহেব বললেন, সামনের ষ্টেশনে নামবে কি ভাবে? ট্রেন তো আর কোথাও থামবে না। ময়মনসিংহ থামবে।
তাহলে স্যার আমরা চেইন টেনে ট্রেন থামায়ে নেমে পড়ব।
জঙ্গলের মধ্যে কোথায় নামবে? ভাওয়ালের জঙ্গল।
কাউসার বলল, ভাওয়ালের জঙ্গলেই নামব। আপনি তো এখন কোনো প্রটেকশান দিতে পারবেন না। কোন ভরসায় থাকব?
যমুনার স্বামী ফয়সল বলল, আমি কাউসার সাহেবের সঙ্গে একমত। আমার মতে আমাদের সবারই নেমে যাওয়া উচিত।
খায়ের সাহেব বললেন, জঙ্গলে নেমে যে আরো বড় বিপদে পড়বে না কে বলল?
সুরমা রাগী গলায় বললেন, বোকার মতো কথা বলবে না। জঙ্গলে কিসের বিপদ? জঙ্গলে কি সিংহ আছে যে আমাদের খেয়ে ফেলবে?
কাউসার বলল, তাহলে ডিসিসান কি হল? আমরা চেইন টেনে ট্রেন থামাব?
খায়ের সাহেব কিছু বলার আগেই ফয়সল বলল, অবশ্যই। এখন দেখা যাবে চেইন টেনেও ট্রেন থামানো যাবে না। টানতে টানতে চেইন ছিঁড়ে ফেললাম ট্রেইন থামল না।
ফয়সলের কথা শেষ হবার আগেই বাতি আবার নিভে গেল। কাউসার চেইন ধরে ঝুলে পড়ল।
ঝাঁকুনি খেতে খেতে ট্রেন থেমে গেল। অস্বাভাবিক দক্ষতায় কাউসার দলবল নিয়ে নেমে পড়ল। ফয়সল নামল যমুনাকে নিয়ে। সুরমা স্বামীর হাত ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করে নিজেও ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পা মচকে ফেললেন।
ট্রেনের ভিতর ছোটাছুটি ব্যস্ততা। অনেকেই চিৎকার করছে ডাকাত ডাকাত। রেল পুলিশ ঘন ঘন হুইসেল দিচ্ছে। ট্রেনের কয়েকটা কামরা থেকে টর্চের আলো দু’পাশের জঙ্গলে ফেলা হচ্ছে। একদল যাত্রী চেঁচাচ্ছে ঐ যে জঙ্গলে ঢুকে। জঙ্গলে ঢুকে। মেয়েছেলে নিয়ে পালায়ে যাচ্ছে। রেল পুলিশ দু’বার রাইফেলে ফাঁকা আওয়াজ করল।
.
রেল পুলিশের রাইফেলের গুলির আওয়াজের সঙ্গে নবজাত শিশুর কান্না মিশল। আশহাব বাচ্চাটাকে পা ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। বাচ্চা একেকবার ফুসফুস ভর্তি করে বাতাস নিচ্ছে এবং চিৎকার করে কাঁদছে। অসময়ে চলে এলেও এই শিশু প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সে তার উপস্থিতি সবাইকে জানান দেবেই। চিত্রা বলল, ছেলে না মেয়ে?
আশহাব বলল, ছেলেই হোক মেয়েই হোক একটি ‘শয়তানই’ যথেষ্ট।
আহা বলুন না। ছেলে না মেয়ে?
আশহাব বলল, মেয়ে হয়েছে।
চিত্রা দরজা খুলে বের হল আনন্দে সে ঝলমল করছে। মনে হল সে তার জীবনের সবচে আনন্দের সংবাদটা দিচ্ছে।
মাওলানা সাহেব! আপনার একটা পরীর মতো সুন্দর মেয়ে হয়েছে।
মাওলানা কিছু বলার আগেই রশীদ উদ্দিন বললেন, অতি সুসংবাদ। নবী এ করিম বলেছেন যার প্রথম সন্তান কন্যা সে মহা সৌভাগ্যভান। আজান দেয়া প্রয়োজন। মেয়েটার কানে আল্লাহর নাম ঢুকুক।
মাওলানা বললেন, মেয়েটার চেহারা দেখে তারপর আজান দেই?
রশীদ উদ্দিন বললেন, আগে আজান তারপর চেহারা।
মাওলানা আজান দিলেন।
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার…
শিশুটিকে শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে মায়ের বুকের কাছে দেয়া হয়েছে। মা এই হাসছেন, এই কাঁদছেন। হঠাৎ তিনি চমকে উঠে বললেন, ডাক্তার আপনি না বললেন মেয়ে। এতো ছেলে।
আশহাব হাসতে হাসতে বলল, একটু ঠাট্টা করলাম।
ছেলের মা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসে বললেন, ডাক্তার তুমি এত দুষ্ট কেন?
মাওলানাকে আসল খবর দেয়ার পর তিনি আনন্দে অভিভূত হয়ে রশীদ উদ্দিনকে জড়িয়ে ধরলেন। মনে হচ্ছে কন্যা সন্তানের আনা ভাগ্যের তাঁর প্রয়োজন নেই। তার জন্যে ছেলেই যথেষ্ট।