চিত্রা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। কয়েন অদৃশ্য করার খেলা সে আগে অনেকবার দেখেছে এ রকম কখনো দেখে নি।
রশীদ সাহেব বললেন, কয়েন ভ্যানিশের ম্যাজিকটা শেখায় আমার একটা বড় লাভ হয়েছে। পদার্থবিদ বন্ধুদের খেলাটা দেখাতে পারব। তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে মজা পাবে। ভিন্ন কারণটা শুনবে?
শুনব।
আগ্রহ নিয়ে শুনবে না-কি শুনতে হয় বলে শুনবে?
আগ্রহ নিয়ে শুনব। চাচা আমি নিজেও Physics-এর ছাত্রী।
রশীদ সাহেব বললেন, পদার্থবিদরা জগত সম্পর্কে হাইপোথিসিস, জগতের নিয়ম সম্পর্কে হাইপোথিসিস দাঁড়া করান। বিপুল উৎসাহে তারা অগ্রসর হন। ম্যাথমেটিকেল মডেল তৈরি হয়। তখন আমাদেরও ডাক পড়ে। কারণ বেশির ভাগ পদার্থবিদ অংকে দুর্বল। তোমাদের আইনস্টাইনের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। যাই হোক মূল কথায় ফিরে যাই। মনে করো পদার্থবিদ একটি সূত্র দাঁড় করালেন–
Y = BC + M + N^2
Y হল B, C, M এবং N–এর ফাংশান।
সব ঠিক মত চলছে হঠাৎ এক সময় নজরে আসবে M অদৃশ্য। শুরুতে M ছাড়া সূত্র কাজ করছে না, মাঝখানে M থাকলে সূত্র কাজ করছে না।
বুঝতে পারছ কি বলছি?
বুঝতে পারছি।
রশীদ সাহেব বললেন, তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে না God পদার্থবিদদের সামান্য ম্যাজিক দেখালেন? হঠাৎ M অদৃশ্য করে দিলেন?
মনে হচ্ছে।
আরেকটা জিনিস কি মনে হচ্ছে–God M-কে অদৃশ্য করে দেন নি লুকিয়ে রেখেছেন। এমন এক সাধারণ জায়গায় লুকিয়েছেন যে আমাদের চোখে পড়ছে না।
চিত্রা বলল, আপনি শিক্ষক হিসেবে নিশ্চয়ই খুব ভাল।
রশীদ সাহেব বললেন, খুব ভাল না। মোটামুটি ভাল। তুমি কি মাওলানা সাহেবের স্ত্রীর কাত্রানী শুনতে পাচ্ছ।
পাচ্ছি।
খুব খারাপ লাগছে না? লাগছে।
অংক হচ্ছে যুক্তি। আমি অংকের Giant. সেই আমি যদি মাওলানা সাহেবকে যুক্তিতে পরাস্ত করতে না পারি তাহলে শিক্ষক হিসেবে আমি দুর্বল শিক্ষক।
চিত্রা বলল, উনাকে তো যুক্তি শুনতে হবে। যুক্তি না শুনলে আপনি তাঁকে পরাস্ত করবেন কিভাবে?
রশীদ সাহেব বললেন, ছাত্র আমার কথাই শুনতে চাচ্ছে না এটাও কি শিক্ষক হিসেবে আমার ব্যর্থতা না?
চিত্রা বলল, উনি তো আপনার ছাত্র না।
রশীদ সাহেব বললেন, একজন শিক্ষকের কাছে সবাই ছাত্র।
.
মাওলানা সাহেবের স্ত্রী আফিয়ার ৩৫ সপ্তাহ মাত্র চলছে। শিশু চল্লিশ সপ্তাহ মায়ের পেটে থেকে বড় হবে। এই চল্লিশ সপ্তাহ সে তার জগতে নিজের মত বড় হবে। সব শেষে তৈরী হবে তার ফুসফুস। ফুসফুস তৈরী হয়ে যাবার পর শিশু সিগন্যাল পাঠাবে মায়ের শরীরে–আমি এখন তৈরি। পৃথিবী দেখব। আমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দাও। মায়ের শরীর ব্যবস্থা নেবেন।
এখানে কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। সময়ের আগেই শিশু বন্দিদশা থেকে মুক্তি চাচ্ছে। আফিয়া বলল, পানি ভাঙছে। পানি।
মাওলানা বললেন, আল্লাহর নাম নাও।
আফিয়া বলল, ডাক্তার লাগবে ডাক্তার।
মাওলানা বললেন, আমি খোঁজ নিয়েছি ট্রেনে লেডি ডাক্তার নেই।
আমি মরে যাব না-কি?
আহারে চিৎকার করছ কেন। মেয়েদের গলার স্বর বাইরের পুরুষের শোনা ঠিক না। পর্দার বরখেলাফ হয়।
আফিয়া গোংগাতে গোংগাতে বলল, মরে গেলাম। আমি মরে গেলাম। মাগো আমি মরে গেলাম।
মাওলানা বিরক্ত গলায় বললেন, আল্লাহর নাম নাও, মা মা করছ কেন? এখানে যা করার আল্লাহপাক করবেন। তোমার মা কি করবেন?
আপনি সামনে থেকে যান। কোনো একজন মহিলাকে ডাকেন। যে কোনো মহিলা। আমার সন্তান বের হয়ে আসতেছে। আমি বুঝতেছি। মাগো তুমি কোথায় মা।
মাওলানা দরজা খুলে বের হয়েই দেখলেন দরজার বাইরে চিত্রা এবং রশীদ সাহেব। মাওলানা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিত্রাকে বললেন, আপনি কি একটু ভেতরে যাবেন?
চিত্রা বলল, আমি ভেতরে গিয়ে কি করব? উনার দরকার একজন ডাক্তার। আমাদের সঙ্গে ডাক্তার আছে। উনাকে ডেকে নিয়ে আসি?
মাওলানা বললেন, পুরুষ ডাক্তার আমি দেখাব না। অসম্ভব। কোনদিনও না।
চিত্রা বলল, আমি ভেতরে যাচ্ছি। বোকার মতো বসে থাকা ছাড়া আমি কিছু করতে পারব না।
চিত্রা ঢুকে গেল। রশীদ উদ্দিন সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললেন, সিগারেট খাবেন। এতে টেনশান কিছু কমবে। নিকোটিনের নার্ভ সুদিং ক্ষমতা আছে।
আমি ধুমপান করি না।
গুড। ভেরি গুড। আমি আপনার দুই মিনিট সময় নিতে পারি? দুই মিনিটে আমি আপনাকে একটা গল্প বলব। গল্প শেষ করে আমি চলে যাব। আপনাকে আর বিরক্ত করব না। আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে আপনি আমাকে দুই মিনিট সময় দিন।
মাওলানা কঠিন গলায় বললেন, আপনাকে দুই মিনিট সময় দিলাম।
রশীদ সাহেব গল্প শুরু করলেন, দেশে একবার বন্যা শুরু হয়েছে। ঘরবাড়ি সব ডুবে যাচ্ছে। উদ্ধারকারী লোকজন নৌকা নিয়ে এসেছে। সবাই নৌকায় উঠে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেলেন। এক মাওলানা শুধু গেলেন না। উনি আল্লাহ ভক্ত মানুষ। উনি বললেন আল্লাহর উপর আমার ভরসা। আল্লাহপাক ব্যবস্থা করবেন।
বন্যার পানি ঘরের চাল পর্যন্ত উঠল। মাওলানা চালে উঠে বসলেন। তখন উদ্ধারকারী লঞ্চ এল। মাওলানা লঞ্চে উঠলেন না। উনার এক কথা, ‘আল্লাহপাক ব্যবস্থা করবেন’। বন্যার পানি আরো বাড়ল। মাওলানার বুক পর্যন্ত উঠল। এল উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার। মাওলানা তাতেও উঠলেন না। হেলিকপ্টার ফিরে গেল।
পানিতে ডুবে মাওলানা মারা গেলেন। মৃত্যুর পর আল্লাহকে গভীর আফসোসের সঙ্গে বললেন, আমি সারাজীবন একনিষ্ঠভাবে আপনাকে ডেকেছি আপনার উপর ভরসা করেছি আর আজ আমাকে কিনা ডুবে মরতে হল। কোনো সাহায্য আপনার কাছ থেকে এল না।