সাজেদা বললেন, তোর এতবড় সাহস? তুই এইভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছিস? আমি আমার বৌমাকে চিনব না।
মা তোমাকে দু’টা ট্যাবলেট দিচ্ছি। ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়। তোমার ঘুম দরকার।
আমার সঙ্গে ডাক্তারী ফলাচ্ছিস? ফেল করা ডাক্তার।
ফেল করা ডাক্তার মানে?
নকল করে ধরা পড়লি মনে নাই। প্রিন্সিপ্যাল তোকে বের করে দিল।
মা তুমি এসব কি বলছ?
তুই আমাকে দিয়ে প্রিন্সিপ্যালের পায়ে ধরালি। একজন মানুষের সামনে কতটা নিচু তুই আমাকে করলি। বদমাশ ছেলে।
মা তোমার অবস্থাতো খুবই কাহিল। কি গল্প ফাঁদছ। এরকম গল্প তোমার মাথায় আসছে কেন? আমি দু’টা সাবজেক্টে হাইয়েস্ট পাওয়া। গোল্ড মেডেল তোমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলাম। মনে নাই?
মনে আছে।
তাহলে এইসব কি বলছ?
আর বলব না।
মাথা কি ঠিক হয়েছে?
হুঁ। হা কর মুখে ভাত দিয়ে দেই।
আশহাব হা করল। সাজেদা ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, আজ তুই আমার হাতে খাবি। তোর হাত নোংরা করার দরকার নেই।
আশহাব কিছু বলল না। সাজেদা বললেন, তুই মাঝে মাঝে এমন গাধার মতো কাজ করিস।
গাধার মতো কাজ কি করলাম?
বৌমাকে নিয়ে প্রথম যাচ্ছিস–তোরা দু’জন যাবি এক কামরায় আমি যাব আলাদা। তা-না তিনজন এক সঙ্গে যাচ্ছি। বেচারী মনটাতো এই জন্যেই খারাপ করেছে। একটু পর পর তোর খুঁজে যাচ্ছে। ওর মনের ভাব আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি।
বুঝতে পারলে তো ভালো। মা আমাকে আর খাইয়ে দিতে হবে না। যথেষ্ট হয়েছে। এখন তুমি খাও।
তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। বৌমাকে রেখে আমি খেয়ে ফেললে সে কি মনে করবে। বাপ নেই, মা নেই একটা মেয়ে। স্নেহের কাঙ্গাল।
আশহাব বিড় বিড় করে বলল, মহা বিপদ।
সাজেদা বললেন, খাওয়া শেষ করে তুই বৌমাকে খুঁজে আনবি। আমি কামরা ছেড়ে দেব তোরা দুই জন এখানে ঘুমাবি। আদর ভালবাসা করতে চাইলে করবি। হুট করে আমি তোদের কামরায় ঢুকব এরকম ভুলেও মনে করবি না। এই বুদ্ধি আমার আছে।
অবশ্যই সেই বুদ্ধি তোমার আছে। ভাত চাবাচ্ছিস না কেন? মুখে দিচ্ছি আর কোৎ করে গিলে ফেলছিস। ভাল করে চাবাতে হবে না। আচার খাবি? একটু আচার দেই?
আশহাব বিড় বিড় করে বলল, Oh God, oh God.
.
চিত্রা রশীদ সাহেবের পাশে বসে আছে। তার চোখ উজ্জ্বল। সে আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছে। বিজ্ঞানের অতি জটিল সব বিষয় এই মানুষ এত সহজে কিভাবে বলছে সে বুঝতে পারছে না। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীতে জটিল বলে কিছু নেই।
রশীদ সাহেব বললেন, মা আমাকে তুমি বল একটা আপেল থ্রি ডাইমেনশনাল বডি না? এর দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং উচ্চতা আছে না?
চিত্রা বলল, জি। অবশ্যই।
রশীদ সাহেব বললেন, আপেলের খোসাটা কিন্তু টু ডাইমেনশনাল। আপেলের খোসার আছে শুধু দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ।
চিত্রা বলল, জি চাচা।
রশীদ সাহেব বললেন, তুমি কি এখন বুঝতে পারছ একটি থ্রি ডাইমেনশনাল বস্তুকে একটি টু ডাইমেনশনাল বস্তু ঘিরে রেখেছে।
জি।
এটা যে সম্ভব তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।
পারছি।
রশীদ সাহেব সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, একই লজিকে আমি যদি বলি থ্রিডাইমেনশনাল কোনো বস্তু দিয়ে ফোর ডাইমেনশনাল জগৎ আটকে রাখা
সম্ভব তাহলে কি বিশ্বাস করবে?
চিত্রা চিন্তিত গলায় বলল, বিশ্বাস করাইতো উচিত।
রশীদ সাহেব বললেন, তোমার কাছে কোনো কিছু যদি অস্পষ্ট মনে হয় আমাকে বলবে। বিজ্ঞান অস্পষ্টতা পছন্দ করে না যদিও হায়ার সায়েন্স পুরোটাই অস্পষ্ট।
কেন?
হায়ার সায়েন্স Big Bang আগে কি হচ্ছে বলতে পারছে না। সময় কি সুষ্ঠু ভাবে বলতে পারছে না, অতীত এবং ভবিষ্যত কি বলতে পারছে না। হায়ার সায়েন্স হঠাৎ বলছে হলগ্রাফিক ইউনিভার্সের কথা। হলোগ্রাফিক ইউনিভার্সের কথা শুনেছ?
না।
বলব?
অবশ্যই বলবেন।
মূল ডিসকাশান থেকে আমি কিন্তু সরে যাব।
মূল ডিসকাশনে পরে যাবেন–হলোগ্রাফিক ইউনিভার্সটা কি আগে বলুন।
রশীদ সাহেব বললেন, এই হাইপোথিসিসে বিশ্ব ভ্ৰহ্মাণ্ড একটা হলোগ্রাম ছাড়া আর কিছুই না…
খোলা দরজায় বসির মাথা বের করে বলল, বিরাট এক সমস্যা হয়েছে। আপা আপনি কি ডাক্তার?
চিত্রা বলল, না তো। আশহাব সাহেব ডাক্তার।
বসির বলল, একজন মহিলা ডাক্তার দরকার। পাঁচ নম্বর কেবিনে এক মহিলার ডেলিভারী পেইন শুরু হয়েছে। উনার হাসবেন্ড মাওলানা। উনি লেডি ডাক্তার ছাড়া তাঁর স্ত্রীকে দেখাবেন না। আমি পুরো ট্রেইন খুঁজে এসেছি। কোনো লেডি ডাক্তার নেই।
রশীদ সাহেব বললেন, ডাক্তারের আবার পুরুষ মহিলা কি? ডাক্তার হল ডাক্তার। আমি মাওলানার সঙ্গে কথা বলি। উনাকে বুঝিয়ে বলি।
বসির বলল, উনি বুঝ মানার লোক না স্যার। কঠিন মাওলানা।
রশীদ সাহেব বললেন, নিশ্চয়ই কেউ তাকে ঠিকমতো লজিক দিতে পারে নি। মানুষ এমন ভাবে তৈরি যে তাকে লজিকের কাছে সারেন্ডার করতেই হয়। উনি যেমন কঠিন মাওলানা, আমিও কঠিন তার্কিক।
বসির বলল, আপনার কথা উনাকে বলে দেখি উনি কথা শুনতে রাজি হন কি-না।
রশীদ সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ইন্টারমিডিয়েট কারোর প্রয়োজন দেখছি না। আমি সরাসরি কথা বলব। তুমি আমাকে নিয়ে চল।
চিত্রা বলল, চাচা আমিও আসি। আমি আপনার লজিক শুনব।
রশীদ সাহেব বললেন, এসো।
.
মাওলানা কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কপালে ঘাম তবে চোখ মুখ কঠিন। তার একটা হাত পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকানো। মনে হচ্ছে ওই হাতে তসবি। কেবিনের দরজা বন্ধ। নারী কণ্ঠের চাপা কাতরানি শোনা যাচ্ছে।