একটা জরুরি টেলিফোন করে আসি। পাঁচটা মিনিট দাও।
মনে থাকে যেন পাঁচ মিনিট—আমি কিন্তু ঘড়ি দেখব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে না এলে যমুনা এসে তোমাকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
সুরমা দ্রুত কেবিনের দিকে রওনা হলেন, তখনই ছোট্ট অঘটন ঘটল। সেলুন কারের একজন এটেনডেন্টের সঙ্গে তাঁর ধাক্কা লেগে গেল। এটেনডেন্টের হাতে ট্রে। ট্রে-তে তিনটা টমেটো জুসের গ্লাস। একটা গ্লাস গড়িয়ে পড়ল সুরমার শাড়িতে। সুরমা কঠিন গলায় বললেন, এই স্টুপিড। তুমি কি অন্ধ। জবাব দাও, তুমি কি অন্ধ? এই শাড়ির দাম জান?
এটেনডেন্ট বেচারা গেল হকচকিয়ে। এইবার তার হাতের ট্রে পড়ে গেল। দ্বিতীয় গ্লাসটাও গড়িয়ে পড়ল। সুরমা চেঁচিয়ে বললেন, এই স্টুপিডটাকে এখানে কে এনেছে? এই ব্যাটা বদমাশ কানে ধর। কানে ধর বললাম।
খায়ের সাহেব বললেন, সুরমা বাদ দাও তো।
সুরমা কঠিন গলায় বললেন, আমার এডমিনস্ট্রেশনে তুমি নাক গলাবে না। এদের শাস্তি না দিলে এরা ঠিক হবে না। হাদার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কানে ধর। কানে ধর বললাম। গুড! এখন উঠবোস কর। আমি না বলা পর্যন্ত থামবে না।
সেলুন কারের যাত্রীরা বের হয়ে এসেছে। নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েরা স্বামী আশে পাশে থাকলে আহ্লাদ করতে পছন্দ করে। যমুনা সেই কারণেই হয়ত বলল, ভিডিও ম্যান কোথায়? এই ভিডিও ম্যান! দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভিডিও করুন না। এমন একটা ইন্টারেস্টিং ইভেন্ট! আপনি ক্যামেরা নিয়ে হা করে আছেন।
ভিডিও ম্যান ভিডিও স্টার্ট করল। যমুনা বলল, আপা দেখ, ক্রিমিন্যাল মুখ বাঁকা করে আছে। কাদার চেষ্টা করছে। কাঁদতে পারছে না। হ্যালো ভিডিও ম্যান! আপনি ওর ফেসটা ক্লোজে ধরুন। বিগ ক্লোজ।
আবুল খায়ের সাহেব এই পর্যায়ে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, খুব জরুরি কথা, ঐদিকে চল। এক্ষুনি এসো। রাইট নাউ। সুরমা অনিচ্ছায় এগিয়ে গেলেন। কানে ধরে উঠবোসের দৃশ্য ভিডিও হচ্ছে। দেখতে তাঁর মজা লাগছে।
সুরমা বললেন, কি বলতে চাও?
আবুল খায়ের বললেন, আমার মন্ত্রীত্ব নেই।
কি বললে?
এক ঘণ্টা আগে খবর পেয়েছি। তোমরা আপসেট হবে বলে তোমাদের বলি নি।
সুরমা হতভম্ব গলায় বললেন, সর্বনাশ!
সর্বনাশ মানে, মহাসর্বনাশ। যাকে শাস্তি দিচ্ছ কিছুক্ষণের মধ্যে সেও জানবে আমি আর মন্ত্রী না। তখন কি হবে বুঝতে পারছ? যাও এক্ষুনি শাস্তি বন্ধ কর। যমুনা আর তার স্বামীকে এখনি কিছু বলার দরকার নেই। তাদেরকে পরে জানালেও হবে।
সুরমা কানে ধরে উঠবোস করা দৃশ্যের কাছে এগিয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, হয়েছে হয়েছে আর লাগবে না। একসিডেন্ট সবারই হয়। আমি নিজে কতবার হাত থেকে গ্লাস ফেলেছি। আমার নিজের মেজাজ অন্য একটা কারণে খারাপ ছিল। ওভার রি-এক্ট করেছি। এই তোমার নাম কি?
সবুর।
সুরমা হ্যান্ড ব্যাগ খুলতে খুলতে বললেন, একশটা টাকা রাখো। চা নাশতা খেও।
সবুর টাকা নিল না। মেঝেতে পড়ে থাকা গ্লাস নিয়ে সেলুন কার থেকে বের হয়ে গেল।
যমুনা বলল, কত বড় বেয়াদব দেখেছ আপা। থাপড়ায়ে এর দাঁত ফেলে দেয়া উচিত ছিল। তুমি আবার মহিলা হাজী মোহাম্মদ মহসীন হয়ে গেলে— একশ টাকা বখশিস।
মাওলানা আজিজুর রহমান স্ত্রীর হাত ধরে বসে আছেন। ভয়ে এবং আতংকে তিনি অস্থির। নিজের মনের ভয় কমানোর জন্যে তিনি ইয়া আহাদু একশবার পড়েছেন। মনের ভয় কমছে না। সত্যি সত্যি ট্রেনে কিছু হয়ে গেলে মহা বিপদ হবে। ট্রেনের এটেনডেন্ট বসিরকে কানে কানে বলেছেন একজন লেডি ডাক্তার আছে কি-না এই খোঁজ করতে। ব্যাটা খোঁজ করবে কি-না কে জানে। তিনি নিজেই প্রতিটি বগিতে গিয়ে ডাক্তার খুঁজতে পারেন। স্ত্রীকে ফেলে যেতে ইচ্ছা করছে না। তিনি মহাবিপদের দোয়া একমনে পড়ে যাচ্ছেন। দোয়া ইউনুস।
ব্যাথার একেকটা প্রবল ঝাপ্টা আসছে আফিয়া স্বামীকে খামচি দিয়ে ধরছে এবং ব্যাকুল গলায় বলছে আমার আম্মু কই। ও আম্মু আম্মু।
মাওলানা বললেন, আল্লা-খোদাকে ডাক। আম্মা আম্মা করছ কেন?
আফিয়া বলল, আল্লাহপাকরে তো আপনি ডাকতেছেন। আমি আম্মুরে ডাকি। ও আম্মু। আম্মু।
মাওলানা বললেন, সমস্যা তুমি তৈরি করেছ। আম্মার কাছে যাব। আম্মার কাছে যাব। এখন দেখেছ অবস্থা। তোমার মার কাছে যাবার জন্যে রওনা না দিলে এই বিপদ হত না।
আফিয়া বলল, চুপ করে বসে থাকেন। কথা বন্ধ। কথা বললে কানে ঝন ঝন করে।
মাওলানা চুপ করে গেলেন। তিনি মনে মনে দুরুদে-শেফা পাঠ করা শুরু করেছেন।
বসির আরেক দফা বরফ এনেছে। রশীদ সাহেব তার হাত ধরে বললেন—
You are a good boy
You will get a toy.
তবে এখন খেলার সময় নয়।
একটা খবর যে জোগাড় করতে হয়।
বসির বলল, স্যার! কি খবর জোগাড় করব?
রশীদ সাহেব বললেন, যে মৃত ব্যক্তিটি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে তার পরিচয় আমার জানা দরকার। জটিল গবেষণার মধ্যে পড়ে গেছি। মৃত ব্যক্তির নাম এবং আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের জন্ম তারিখ জানা অতি জরুরী।
বসির বলল, মরা মানুষ তো কেউ যাচ্ছে না।
তুমি তো খবর দিলে একটা ডেড বডি যাচ্ছে।
বসির লজ্জিত গলায় বলল, ভুল খবর দিয়েছিলাম স্যার। চাদর দিয়ে ঢেকে কামরায় তুলেছে তখন ভেবেছি লাশ।
এখন সে লাশ না?
জি-না। চা-কফি খেয়েছে।
ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
বয়স কত?
ত্রিশ পঁয়ত্রিশ।
নাম জিজ্ঞেস করেছ?