মাওলানা সাহেবের নাম আজিজুর রহমান। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। রোগা পাতলা চেহারা থুতনিতে সামান্য দাড়ি। মাওলানা সাহেব মনে হচ্ছে শৌখিন মানুষ। তাঁর গায়ের পাঞ্জাবীটা দামী। ফুলের নকশা কাটা। পাঞ্জাবীর উপর যে শালটা দিয়েছেন সেই শালও যথেষ্ট দামী। মাথার টুপিটা রঙিন নকশাদার।
মাওলানা স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি করছেন তবে গলা নামিয়ে। রাগারাগির কারণ তাঁর স্ত্রী আফিয়া মাগরেবের নামাজ পড়ে নি।
মাওলানা বললেন, নামাজটা কেন পড়লে না একটু বলতো শুনি। তুমি জান নামাজ কাজা করতে দেখলে আমার ভাল লাগে না।
আফিয়া বলল, আমার শরীরের যে অবস্থা নিচু হতে পারি না। সেজদায় যাব কি ভাবে?
বসে বসে নামাজ পড়। তোমার এই অবস্থায় বসে নামাজ জায়েজ আছে।
আফিয়া বলল, আমার অবস্থা দেখলে আল্লাহপাক বলতেন, যা বেটি তোর নামাজ এখন মাফ।
মাওলানা স্ত্রীর বেয়াদবিতে কিছুক্ষণের জন্যে বাক্যহারা হলেন। নিজেকে সামলাতে সময় লাগল। ধর্ম কর্ম, আল্লাহপাক এই সব অতি গুরুতর বিষয় নিয়ে আফিয়ার হালকা কথাবার্তার অভ্যাস আছে। আগে অনেকবার লক্ষ্য করেছেন। অনেকবার নিষেধও করেছেন।
আফিয়া!
জি।
তুমি একটু আগে মস্তবড় একটা গুনার কাজ করেছ। তওবা কর। তওবা করার পর কাজা নামাজ পড়।
কি ভাবে তওবা করব?
আমার সঙ্গে তিনবার বল, আল্লাহুম্মাগ ফিরলি ওয়ার হামনি।
আফিয়া তিনবার বললেন।
তোমার অজু আছে না?
আছে।
জানালার সামনে বসে বসে পড়। জানালাটা পশ্চিম।
ট্রেন যখন ঘুরবে তখনতো কেবলা বদলে যাবে।
মাওলানা বিরক্ত গলায় বললেন, চলন্ত ট্রেনে নামাজে দাঁড়াবার সময় কেবলা ঠিক করে নিতে হয়। এরপরে কেবলা বদলে গেলে অসুবিধা নাই।
আফিয়া বললেন, আপনি আমার জন্যে আরেক বোতল পানি আনেন। পানি খেয়ে তারপর নামাজ পড়ব।
মাওলানা বললেন, আগের বোতলের পানিতে শেষ কর নাই অর্ধেক এখনো আছে। আফিয়া তুমি নামাজ না পড়ার বাহানা করছ। আল্লাহপাক খুবই রাগ হবেন।
আফিয়া বলল, আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি। আমি এখন নামাজ পড়লেই আল্লাহপাক রাগ হবেন। আমার পানি ভাঙছে। আপনি চিন্তায় পড়বেন বলে কিছু বলি নাই। ট্রেনেই আমার সন্তান হবে। আপনি খোঁজ নেন ট্রেনে কোনো ডাক্তার আছে কি-না।
কথা শেষ করার আগেই প্রবল ব্যাথায় আফিয়া মুখ বিকৃত করল। চাপা গলায় তার মাকে ডাকল—মা! মা গো। মাওলানা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। একি মুসিবত! আল্লাহপাকের এটা আবার কোন পরীক্ষা।
এই মুহূর্তে হতভম্ব অবস্থায় অন্য যে ব্যক্তি মোবাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তার নাম এ কে কে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল খায়ের খান। তিনি কোন দলের মন্ত্রী তা ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন নেই, সব দলের মন্ত্রীই এক। তাদের মধ্যে গুণগত প্রভেদ যেমন নেই, দোষগত প্রভেদও নেই। তাঁদের সঙ্গে গ্রাম্য বাউলদের কিছু মিল আছে। বাউলরা যেমন বন্দনা না গেয়ে মূল গান গাইতে পারেন না, এরাও সে রকম নিজ নিজ নেত্রীর বন্দনা না গেয়ে কোনো কথা বলতে পারেন না।
আবুল খায়ের খান সাহেবের হাতে মোবাইল। তিনি মোবাইল বন্ধ করার পরেও মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর গলায় টক ভাব হচ্ছে। প্রচণ্ড এসিডিটি হলে এ রকম হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুক জ্বলা শুরু হবে।
মন্ত্রী মহোদয়ের বুক জ্বালা করার কারণ এসিডিটি না। তিনি এই মাত্র জেনেছেন তার মন্ত্রীত্ব নেই। আসল জায়গা থেকে খবর এখনো আসেনি। যে জায়গা থেকে এসেছে সেটাও নির্ভরযোগ্য। তিনি ইচ্ছা করলেই আরো কয়েকটা টেলিফোন করে মূল সত্যটা জানতে পারেন। এই মুহূর্তে ইচ্ছা। করছে না।
মন্ত্রী মহোদয়ের স্ত্রী সুরমা হাতে টমেটো জুস নিয়ে এগিয়ে এলেন। আহ্লাদি গলায় বললেন, এই, গান কখন শুরু হবে? যমুনা আর তার বর গান শুনতে চাচ্ছে।
যমুনা সুরমার ছোট বোন। গত সপ্তাহে সেনাকুঞ্জে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর তার মন্ত্রী দুলাভাই তাদের দেশের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন। আনন্দ ফুর্তি করতে করতে যাওয়া হবে ভেবেই ট্রেনে যাওয়া হচ্ছে। সেলুন কারে নানান আনন্দ ফুর্তির ব্যবস্থা। একটা ব্যান্ড দল যাচ্ছে। ব্যান্ডের নাম Hungry। ভিডিও ম্যান যাচ্ছে। তার দায়িত্ব ভিডিও করা। কোনো আনন্দ যেন বাদ না পড়ে। ঢাকা ক্লাব থেকে একজন বারটেনডার নেয়া হয়েছে যে ককটেল বানানোয় ওস্তাদ। সম্প্রতি সুরমার ককটেল আসক্তি হয়েছে। তিনি বিশেষ বিশেষ পার্টিতে ককটেলের ব্যবস্থা রাখেন। সিঙ্গাপুর থেকে ককটেল বানানোর উপর একটা বইও কিনেছেন। তাঁর ইচ্ছা আজ বই দেখে কয়েকটা আইটেম বানাবেন।
সুরমা বললেন, এই, কথা বলছ না কেন? গান কি শুরু হবে?
মন্ত্রী শুকনো গলায় বললেন, হুঁ।
তোমার শরীর খারাপ না-কি?
এসিডিটি হচ্ছে।
সুরমা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, এন্টাসিড খেয়ে এক গ্লাস ঠাণ্ডা দুধ খাও। দুধ নিয়ে এসেছি। দেব?
দাও।
একটু আগে টেলিফোন কে করেছে?
অফিস থেকে।
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, তারা কি একটা সেকেন্ডের জন্যে তোমায় বিশ্রাম দেবে না! দিন রাত কাজ করতে হবে? মোবাইলটা অফ করে রাখতো। মন্ত্রী তো আরো আছে। একমাত্র তোমাকেই দেখলাম জীবনটা দিয়ে দিচ্ছ। নেত্রীর এত কাছের যে সালাম সাহেব সন্ধ্যার পরেইতো সে বোতল নিয়ে বসে। তখন তার টিকির দেখা পাওয়া যায় না।
মন্ত্রী বললেন, থামতো।
সুরমা বললেন, থামব কেন? সত্যি কথা বলতে আমি ভয় পাই না। আমি সালাম সাহেবের মুখের উপর এই কথা বলতে পারব। তার স্ত্রী গত এক মাসে তিনবার বিদেশ গিয়েছে। বেইজিং থেকে একটা খাট কিনে এনেছে একুশ হাজার ডলার দামে। টাকা কোত্থেকে আসে আমি জানি না? আমি চামচে দুধ খাওয়া মেয়ে না।