প্রিয় আতাহার,
তোদের ব্যাপারটা কি আমাকে বলবি? কি হচ্ছে না হচ্ছে আমাকে কিছুটা জানাবি না? আমিতো তোর বোন। বাবা-মা তো আমাকে মেঘনা নদীর জল থেকে তুলে আনেন নি।
মায়ের কবর কোথায় হল? জানাজায় কত লোক হয়েছিল কিছুই আমাকে জানাবি না? প্রতি দিন তোদের কথা ভাবি–এই তার প্রতিদান। তোদের কথা এত বেশি ভাবি বলেই দিন রাত তোর দুলাভাইয়ের বাক্যবান সহ্য করতে হয়।
যাই হোক এখন তোকে একটা সুসংবাদ দিচ্ছি। তোর এবং ফরহাদের ইমিগ্রেশন হয়েছে। তোদের নিজেদের তো কোন গরজ নেই দুকপি ছবি পাঠানোর কথা বললে পাঠাবি না। তিনবার চারবার মনে করিয়ে চিঠি দিতে হবে। বার্থ সার্টিফিকেটের মত সামান্য সার্টিফিকেট জোগার করতে তোদের লাগে তিন মাস। আল্লাহর অসীম মেহেরবানী এখানে একজন ভাল লইয়ার পেয়েছিলাম। উনি প্রচুর ডলার নিয়েছেন, কিন্তু কাজ ভাল করেছেন।
তোরা প্রথম কিছুদিন এসে আমার এখানেই থাকবি তারপর নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নিবি। লোকে যে বলে আমেরিকায় পথে-ঘাটে ডলার উড়ে বেড়ায় ধরতে জানলেই হল, কথাটা মিথ্যে না। সাউথ ইন্ডিয়ান এক ভদ্রলোক আমেরিকায় এসে এক অফিসে জেনিটারের চাকরি নিলেন। মেঝে ঝাড় দেন। কমোড পরিস্কার করেন। পাঁচ বছরের মাথায় ভদ্রলোক মিলিওনীয়ার হয়েছেন। তাঁর বেশ কয়েকটা ফার্স্ট ফুডের দোকান আছে। নাম হল কাপ্লাস ইটারি। ভদ্রলোকের নাম হরিকল্প। তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। ভদ্রমহিলা অতি মিশুক। তিনি তাঁর স্বামীকে বলে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। বাকি আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।
এক হাজার ডলারের একটা ব্যাংক ড্রাফট পাঠালাম। তোদের এখানে ডলার এখন কত করে? চল্লিশ করে না? যদি চল্লিশ করে হয় তাহলে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা পাবি। এই টাকাটা তোদের দুই ভাইকে আমি ধার হিসেবে দিচ্ছি। আমেরিকা এসে শোধ করবি। এবং টাকার ব্যাপারটা যেন কোন ক্রমেই তোর দুলাভাই না জানে। টাকাটা দিয়ে তোরা ভালমত জামা কাপড় বানিয়ে আনবি। টিকিট আমি পিটিএ করে পাঠাব। ভাল কথা, আমার জন্যে ভাল কাসুন্দ আনতে পারবি? কদিন ধরে হঠাৎ কাসুন্দি দিয়ে মাছ ভাজা খেতে ইচ্ছা করছে। এখানে শ্যাডা নামের এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়। আমাদের ইলিশ মাছের মত, তবে স্বাদ কম। তোদের খাওয়াব। আমরা এখন আর ডিফারেন্স ধরতে পারি না। তোরা নিশ্চয়ই পারবি।
ভাল কথা, মা-বাবা এই দুজনের কবরই আমি বঁধাতে চাই। কালো গ্রানাইট পাথরে বাধাতে কত খরচ পড়বে আমাকে জানাবি। কবে দেশে আসব, তাতো জানি না। এলে যেন মার কবরের একটা চিহ্ন দেখতে পাই।
ইতি তোর
মনিকা আপু
এক হাজার ডলারের ব্যাংক ড্রাফটাটা আতাহার ঘুরিয় ফিরিয়ে দেখল। সামান্য একটা কাগজ। যে কাগজে নগদ মূল্যে অনেক খানি সুখ কেনা যায়।
পরিমল বাবুর কাশি শুরু হয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমেরিকায় গেলে ক্যাসেটে পরিমল বাবুর কাশি রেকর্ড করে নিয়ে যেতে হবে। ঘুমুবার আগে কাশি না শুনলে ঘুম হবে না।
খক খ্যক খকর খক। খুখু খু— খকর খকর খকর–হ হ হ খক খক খক। কাশি চলছেই।
ড্রাগ এডিক্ট টিটমেন্ট সেন্টার
হোসেন সাহেব সাজ্জাদকে ড্রাগ এডিক্ট টিটমেন্ট সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। তার ধারণা ছিল সাজ্জাদ প্রবল আপত্তি করবে। তা সে করেনি। বাবার একটা কথাতেই রাজি হয়েছে। নিজেই আগ্রহ করে সুটকেসে কাপড় চোপড় নিয়েছে, বইপত্র নিয়েছে। ঘরে ছোট পোর্টেবল ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল না। ড্রাইভারকে পাঠিয়ে বায়তুল মোকাররাম থেকে কিনিয়ে আনিয়েছে।
হোসেন সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে ছেলে চিকিৎসা কেন্দ্ৰে পাঠানোর দুঃখে এবং লজ্জায় তিনি মরে যাচ্ছেন। সাজ্জাদের চোখে চোখ রেখে কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না। তিনি কথা বলছেন অন্য দিকে তাকিয়ে।
বাবা সাজ্জাদ!
জ্বি।
ড্রাগের সমস্যাটা তো বাবা মানসিক। তার জন্য তুমি লজ্জিত হয়ো না, বা দুঃখিত হয়ো না। দোষটা পুরোপুরিই আমার।
সাজ্জাদ বলল, তোমার হবে কেন?
আমি তোমাকে প্রপার গাইডেন্স দিতে পারিনি। তোমার মা পাশে ছিল না, একা একা তোমাদের মানুষ করতে গিয়ে ভুল করেছি।
তুমি কোন ভুল করনি বাবা। ভুল পুরোটাই আমার। একুশে পদকের মত শ্ৰেষ্ঠ পিতা পদক বলে কোন জাতীয় পদক থাকলে অবশ্যই তুমি সেই পদক পেতে।
হোসেন সাহেবের চোখ ভিজে উঠল। মনে হচ্ছে তিনি কেঁদে ফেলবেন। অনেক কষ্টে তিনি নিজেকে সামলালেন। সাজ্জাদ বলল, বাবা শোন, আমার জন্যে তুমি কষ্ট পোচ্ছ এই দুঃখ আমার রাখার জায়গা নেই। আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি সুস্থ হয়ে ফিরব। এবং তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে আমি ড্রাগ স্পর্শ করব না। তবে তোমার মৃত্যুর পর কি হবে আমি জানি না।
তুই চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি হচ্ছিস এটা কাউকে জানানোর দরকার নেই।
জানালেও কোন ক্ষতি নেই বাবা। শরীরের অসুখের কথা যেমন জানানো যায়, মনের অসুখের কথাও জানানো যায়।
দরকার কি?
তুমি জানাতে না চাইলে জানিও না।
যে সাইকিয়াটিস্ট তোর চিকিৎসা করবেন তার নাম রুবিনা। রুবিনা হক। খুব নাম করা সাইকিয়াটিস্ট।
বুঝলে কি করে নাম করা?
আমেরিকার সেন্ট পল হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিস্ট বিভাগে ছিলেন। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি খুব ইমপ্রেসড। তোর যে সব সমস্যা তাকে খোলাখুলি বলবি। ডাক্তার এবং উকিল এদের কাছে কিছু লুকাতে নেই।