কোনকিছু নিয়েই কণা বেশীক্ষণ ভাবতে পারে না। তার ভাল লাগে না, মাথা ধরে যায়। কিন্তু পেটের শিশুগুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার ভাবতে ভাল লাগে। শুধু যে তার ভাবতে ভাল লাগে তা না–এদের নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তার কথা বলতেও ভাল লাগে। তার কথা বলার লোক কোথায়? কাজেই সে নিজেই আশে পাশে থেকে লোক খুঁজে নেয়। হয়ত সে রিকশা করে যাচ্ছে–সে ফস করে বলে বসিল, রিকশাওয়ালা ভাই আপনের ছেলেমেয়ে কি? রিকশাওয়ালা চমকে পেছন ফিরে তাকায়। তার চোখে চাপা সন্দেহ বিকবিক করে। কণার ধারণা তাকে হয়ত খারাপ মেয়ে ভাবে। খারাপ মেয়েরাই রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে দ্রুত ভােব জমাবার জন্যে ব্যক্তিগত গল্প শুরু করে। তখন কণা তার বিশেষ হাসিটা হাসে। এই হাসি বলে দেয়–সে খারাপ মেয়ে না। ভাল মেয়ে। এরকম ভাল মেয়ে সচরাচর পৃথিবীতে আসে না। তবে ভাল মেয়ে হলেও সে খুব দুঃখী মেয়ে। এ রকম দুঃখী মেয়েও সচরাচর পৃথিবীতে আসে না।
কণা উঠে দাঁড়াল। এক জায়গায় বসে থাকতে থাকতে তার পায়ে ঝি ঝি ধরে গেছে। একটু হাঁটাহাঁটি করলে বোধহয় ভাল লাগবে। কণা বারান্দায় চলে এল। বারান্দাটা ফাঁকা। টুলের উপর একজন খাকি পোষাক পরা পিয়ন বসে আছে। বেচারা বোধ হয়। কয়েক রাত ঘুমায়নি। আয়েশ করে ঝিমাচ্ছে। তাকে কি কণা জিজ্ঞেস করবে–পিয়ন ভাই, আপনার ছেলেমেয়ে কি? কণা নিশ্চিত এই প্রশ্ন করা মাত্রই পিয়নের চোখ থেকে ঘুম কেটে যাবে। সে লাফ দিয়ে উঠবে।
আচ্ছা, কণা কি পারেনা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পেটের শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে? সে নিজে যদি বেঁচে থাকতে পারে তার শিশুটি থাকবে না কেন? আচ্ছা, সেতো সাজ্জাদ নামের দারুণ বড়লোক ঐ ছেলেটার কাছে চলে যেতে পারে। পারে না? তাকে গিয়ে বলতে পারে–
সাজ্জাদ ভাই আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি কণা।
উনি হাসি মুখে বলবেন, হ্যাঁ চিনতে পারছি। কেমন আছ কণা?
ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভাল আছি।
কণা, তোমাকে কেমন জানি রোগা রোগ লাগছে। তোমার কি কোন অসুখ
উহুঁ। আমি খুব ভাল আছি। আমি আপনার কাছে একটা কাজে এসেছি।
বল কি কাজ?
আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান। এটা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
এখনো কি চান?
হ্যাঁ, এখনো চাই।
আমি রাজি আছি সাজ্জাদ ভাই।
সত্যি রাজি আছ?
হ্যাঁ সত্যি–তিন সত্যি।
তিন সত্যিটা কি?
মাটির সত্যি, আকশের সত্যি আর পাতালের সত্যি।
তাহলে তুমি চলে এসো।
একটা কিন্তু আছে যে সাজ্জাদ ভাই।
কিন্তুটা কি?
আমার পেটে একটা শিশু আছে। শিশুটিকে আমি বড় করতে চাই।
অবশ্যই বড় করবে।
আমার স্বামীকেও তো ছেড়ে চলে আসতে হবে।
তাতো হবেই, আমাদের বর্তমান সমাজ এক স্বামীর দুটি স্ত্রী সহ্য করে নিলেও, এক স্ত্রীর দুই স্বামী সহ্য করবে না।
কিন্তু ওকে তো আমি প্রচণ্ড রকম ভালবাসি।
তোমার ভালবাসার ক্ষমতা আছে বলেই তুমি ভালবাস। আজ তুমি তোমার স্বামীকে প্রচণ্ড ভালবাসছ–একদিন আমাকেও প্রচণ্ড ভালবাসবে। ভালবাসা নির্ভর করে ভালবাসার ক্ষমতার উপর।
তাও ঠিক।
একটা কথা কি জান কণা, ভালবাসতে হলে ভালবাসার উপকরণ লাগে। ক্ষুধার্ত পেটে ভালবাসা যায় না। আমার কাছে ভালবাসার উপকরণ আছে। আমি তোমাকে নিয়ে কি করব জান?
কি করবেন?
জোছনা রাত্রিতে তোমাকে গাড়িতে করে নিয়ে যাবো শহর থেকে দূরে। আশি, নব্বুই, একশ কিলোমিটার স্পীডে গাড়ি চলবে। হাওয়ায় উড়বে তোমার চুল।
আমরা কোথায় যাব?
তুমি যেখানে যেতে চাও আমি তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাব।
আমি কখনো সমুদ্র দেখিনি–আপনি আমাকে সমুদ্র দেখাবেন?
অবশ্যই দেখোব। তুমি চাইলে সমুদ্রের কোন এক প্রবাল দ্বীপে তোমার জন্যে ঘর বানিয়ে দেব। তুমি কি চাও?
হ্যাঁ চাই।
শোন কণা, তোমার স্বামীর এত ভালবাসার দরকার নেই। আমার দরকার। আমার প্রচুর ভালবাসা দরকার।
কণা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নার্স এসে বিরক্ত মুখে বলল, আপনি এখানে? আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আসুন ভেতরে আসুন। ডাক্তার এসে গেছেন। ফরম ফিলাপ করেছেন?
কণা শুকনো গলায় বলল, জ্বি।
আসুন তাহলে।
কণা ক্লান্ত গলায় বলল, চলুন।
নার্স বলল, ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছু নেই।
কণা বলল, আমি ভয় পাই না।
টেবিলের উপরে টিফিন কেরিয়ার
টেবিলের উপরে টিফিন কেরিয়ার থাকার কথা।
টিফিন কেরিয়ার নেই। আতাহার ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজতে এগারো মিনিট। এত রাতে নিশ্চয়ই টিফিন কেরিয়ার নিয়ে কেউ আসবে না। খাবার পাঠাতে কি ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না। ধরে নেয়া যেতে পারে আতাহারের বড় মামার বাড়িতে দৈনন্দিন কাজের একটা অলিখিত তালিকা আছে। টিফিন কেরিয়ারে করে আতাহারকে খাবার পাঠানোর কাজটা তালিকায় একেবারে শেষের দিকে। যার উপর দায়িত্ব সে সম্ভবত জ্বরে পড়েছে। কিংবা ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গেছে।
বেছে বেছে আজকের দিনেই ক্ষিধেয় আতাহারের নাড়িভূড়ি উল্টে আসছে। দোকানপাট এখনো কিছু কিছু খোলা। গোটা দুই কলা কয়েকটা বিসকিট এবং এক কাপ চা খেয়ে এলে হয়। সেটাও সম্ভব না। পকেটে কিছু নেই।
আজ নিয়ে তিন দিন সে শূন্য পকেট নিয়ে ঘুরছে। একটা লাভ হয়েছে সিগারেট খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আজ সারা দিনে মাত্ৰ দুটা সিগারেট খাওয়া হয়েছে। তৃতীয় সিগারেটটা পাঞ্জাবির পকেটে আছে। রাতের খাবার পর আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে ধরাবে এমন পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ আয়েশ করে সিগারেট ধরানোটা করা যাবে। প্রথম অংশ খাওয়া দাওয়া বাদ দিতে হবে।