আতাহার ঘৃণা ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদের চোখে কোন ঘৃণা নেই, বিস্ময়ও নেই। তার চোখে শুধুই কৌতূহল। নির্ভেজাল কৌতূহল।
কুদ্দুস টিনের কোটা থেকে একটা টিকটিকি বের করে আনল। বা হাতের আঙুলে একটা টোকা দিতেই টিকটিকির লেজ খসে পড়ল। কুদ্দুস হাসিমুখে বলল, বড়ই আজিব পোকা। লেজ খুইল্যা পড়ে, আবার লেজ হয়।
ছাদের দিকে মুখ করে কুদ্দুস প্রকাণ্ড হা করে টিকটিকিটা মুখের ভেতর ছেড়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করল। কচ কচ শব্দ হচ্ছে।
আতাহার ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে দুহাতে পেট চেপে রাস্তায় বসে পড়ল। মনে হচ্ছে বমি করতে করতে সে রাস্তাতেই নেতিয়ে পড়বে। রাস্তা ফাকা, দূরে ডাস্টবিনের কাছে একটা কুকুর ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। কুকুরটা ভীত পায়ে আতাহারের দিকে আসছে। আতাহারের মনে হল কুকুরটার চোখ মমতা ও সহানুভূতিতে আর্দ্র। আতাহার ডাকল, আয় আয়, তুই আমার কাছে আয়।
কালো রঙের কুকুর এগিয়ে আসছে। আতাহার আবারো ডাকল, আয় আয়–। কি আশ্চর্য! এই অদ্ভূত অবস্থাতেই তার মাথায় কবিতার লাইন আছে। কোন মানে হয়? একজন কবি সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করেন–একগাদা বমি সামনে নিয়ে সে বসে আছে। এর ভেতর সৌন্দর্য কোথায়? সৌন্দর্যের জন্ম অন্ধকারে। আলোর জন্মদাত্রী মা অবশ্যই অন্ধকার।
একটা ঝকঝকে রঙিন কাচপোকা
হাঁটতে হাঁটতে এক ঝলক রোদের মধ্যে পড়ে গেলো।
ঝিকমিকিয়ে উঠল তার নকশাকাটা লাল নীল সবুজ শরীর।
বিরক্ত হয়ে বলল, রোদ কেন?
আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার।
আমার ষোলটা পায়ে একটা ভারি শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি–
অন্ধকারকে দেখব বলে।
আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার।
একটা সময়ে এসে রোদ নিভে গেল।
বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল আঁধার।
কি গাঢ়, পিচ্ছিল থকথকে অন্ধকার!
কাচপোকার ষোলটা ক্লান্ত পা বার বার
সেই পিচ্ছিল আঠালো অন্ধকারে ডেবে যাচ্ছিল।
তার খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে।
তবু সে হাঁটছে–
তাকে যেতে হবে আরো গভীর অন্ধকারে।
যে অন্ধকার–আলোর জন্মদাত্রী।
কণার মুখ হাসিহাসি
কণার মুখ হাসিহাসি।
তাকে দেখে মনে হতে পারে আনন্দময় কোন অভিজ্ঞতার জন্যে সে অপেক্ষা করছে। তার গায়ে ইস্ত্রি করা সুতীর ছাপা শাড়ি। শাদা জমিনে নীল রঙের ফুলের ছাপ। কণাকে দেখে মনে হচ্ছে তার শরীরে নীল ফুল ফুটে আছে। সত্যি সত্যি ফুটে আছে। কণা মাথায় গন্ধ তেল দিয়ে চুল বেঁধেছে। মাথার গন্ধটাকেই মনে হচ্ছে ফুলের গন্ধ।
নার্স ঘরে ঢুকে কণার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ঘণ্টা খানিক।
কণা ঠিক আছে বলে আগের মত হাসি হাসি মুখ করে বসে রইল। নার্স বলল, আপনার স্বামী আসেন নি?
জ্বি না।
উনি এলে ভাল হত।
কণা হাসল। সেই হাসি যা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে ফেলে। কণা তার তেইশ বছরের জীবনে এই হাসি অনেকবার ব্যবহার করেছে। হয়ত আরো অসংখ্যবার ব্যবহার করতে হবে। তার এখন আর ভাল লাগে না। হাসিটা সে শুধুমাত্র একজনের জন্যেই ব্যবহার করতে চায়। হাসি হল শরীরেরই একটা অংশ। ঠোঁটের ফাকে ফুলের মত ফুটে ওঠে। শরীর যেমন সবার জন্যে নয়–হাসিও তেমনি সবার জন্য না।
কণা বসে আছে ধানমণ্ডি পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকে। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে তার পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলা হবে। নতুন। একজন মানুষের দায়িত্ব নেয়ার সামৰ্থ তার স্বামীর নেই। অনেক আলাপ আলোচনা করে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবার পর কণা হোসেছে খিলখিল করে। কণার স্বামী বিরক্ত মুখে বলেছে, হাস কেন?
কণা বলেছে, হাসতে ভাল লাগে এইজন্যে হাসি। ছোটবেলায় খুব কাঁদিতাম এইজন্যে নাম হয়ে গিয়েছিল কাদুনি। কী দুনি থেকে কানি। কানি থেকে কণা। বুঝলেন সাহেব?
এত কথা বল কেন?
আচ্ছা যাও, কথাও বলব না।
কণা শান্ত মুখে কেরোসিনের চুলা ধরিয়েছে। কৌটায় সামান্য কিছু কফি আছে। স্বামীকে কফি বানিয়ে দিয়ে সে অবাক করে দেবে। চা ভেবে চুমুক দিয়ে দেখবে কফি। সে আঁৎকে উঠবে। মজার একটা ব্যাপার হবে। কণা সারাজীবন চেয়েছে তাকে ঘিরে সারাক্ষণ মজার মজার সব ঘটনা ঘটুক। কিন্তু তার জীবনটা এ রকম যে তাকে ঘিরে মজার কোন ঘটনা কখনো ঘটে না। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে।
তাকে কাপড় খুলে আধাবুড়ো একজন মানুষের সামনে নানান অঙ্গ ভঙ্গি করে বসে থাকতে হয়। আধাবুড়ো মানুষটা তার ছবি আঁকে। তবে মানুষটা ভাল। ঋষির মত মানুষ। মানুষটার চোখে লোভ ঝিলমিল করে না। কখনোই সে কোন অজুহাতে হাত দিয়ে তার নগ্ন শরীর জুয়ে দেয় না। মানুষ এ রকম হয় কিভাবে?
একটা স্বাভাবিক জীবন কণার কেন হল না? আল্লাহ কি জন্মের সময় তার কপালে লিখে দিয়েছেন–এই মেয়েটার কোন স্বাভাবিক জীবন হবে না? সে সরক্ষণ ভয়ংকরের ভেতর থাকবে। তার গর্ভে আসবে সুন্দর সুন্দর শিশু। তাদের একের পর এক ফেলে দিতে হবে। কোনদিন তাদের সে কোলে নিতে পারবে না। তাদের ঠোঁটে চুমু দিতে পারবে না। রাতের বেলা কাধে শুইয়ে সুর করে বলতে পারবে না–
আমার কথাটি ফুরাল
নটে গাছটি মুড়াল।
কেনরে নটে মুড়ালি?
গরুতে কেন খায়?
কেনারে গরু খাস?
রাখাল কেন চরায় না?
কেনরে রাখাল চরাস না?
বৌ কেন ভাত দেয় না?
কোনলো বৌ ভাত দিস না?
কলাগাছ কেন পাতা ফেলে না?
কেনরে কলাগাছ পাতা ফেলিস না?
জল কেন হয় না?
কেনরে জল হস না?
ব্যাঙ কেন ডাকে না?
কেনারে ব্যাঙ ডাকিস না?
সাপ কেন খায়?
কেন রে সাপ খাস?
খাবার ধন খাবুনি,–গুড় গুড়ুতে যাব নি?