আমি জানি তোমার মন ভয়ংকর খারাপ। ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তারপরেও এসো আমরা খানিকক্ষণ গল্প করি। জানোলা দিয়ে তাকিয়ে দেখ বাইরের আকাশ কি ঘন নীল। কত না মধুর বাতাস। তোমার চারদিকে জীবন ঝলমল করছে— এর মাঝখানে মৃত্যু নিয়ে ভেবোনাতো।
আতাহার করিডোর ধরে এগুচ্ছে। তার একটা টেলিফোন করা দরকার। তার মন বলছে পরিচিত কারো সঙ্গে খানিকক্ষণ সাধারণ কোন বিষয় নিয়ে কথা বললেই তার মন ঠিক হয়ে যাবে। যে কোন বিষয় নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে–আওয়ামী লীগ, বিএনপি রাজনীতি। খালেদা হাসিনার ঠাণ্ডা স্নায়ু যুদ্ধ। গ্ৰীন হাউস এফেক্ট পরিবেশ গত বিপর্যয়। বিষ্ণুদের কবিতায় ভুল ছন্দ …
হাসপাতাল এবং রেলওয়ে ইনকোয়ারির টেলিফোন কখনো ডায়াল টোন থাকে না। রিসিভার উঠালে হয়। ভয়াবহ নীরবতা কাকে বলে তা বোঝা যায় কিংবা কট কট শব্দ হয়। মনে হয় কেউ যেন জাতি দিয়ে টেলিফোনের তার কাটছে।
আতাহার বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল হাসপাতালের ইনকোয়ারির টেলিফোন ঠিক আছে। ডায়াল টোন আসছে। সে সাজ্জাদের নাম্বার ডায়াল করল। দুবার রিং হতেই সাজ্জাদ বলল, আতাহার তোর খবর কিরে?
আতাহার বিস্মিত হয়ে বলল, বুঝলি কি করে আমি?
মাঝে মাঝে আমার সিক্সথ সেন্স খুব কাজ করে। রিং বাজা মাত্রই মনে হল তুই। খবর কি রে?
তেমন কোন খবর নেই।
তুই বাসায় চলে আয়। এক্ষুণি চলে আয়।
এখন আসতে পারব না। একটা সমস্যা আছে।
মানুষ হয়ে জন্মেছিস সমস্যাতে থাকবেই। চলে আয়।
এখন আসতে পারব না। সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকব।
রাতে আসবি?
হ্যাঁ, তা আসতে পারি। কোথায়?
এখন বলব না। আগে এরেঞ্জ করে নেই।
আসে-পাশে কি নীতু আছে নাকি?
না। কথা বলবি? ডেকে দেই?
দে।
আতাহার টেলিফোন ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ইস, কেউ যদি এক মগ গরম এসপ্রেসো কফি তার হাতে ধরিয়ে দিত। আর একটা ডানহিল সিগারেট। ফেনা ভর্তি কফির মাগে চুমুক দিতে দিতে সে টেলিফোনে কথা বলতে পারত।
আতাহার ভাই!
কে, নীতু?
হুঁ।
তুই আছিস কেমন?
ভাল।
জ্বর কমেছে?
হুঁ।
শুনলাম কামাল সাহেবের সঙ্গে বিয়েটা হচ্ছে না। এ রকম হুটহাট ডিসিশান নিস কেন? খুব খারাপ।
আপনার কি হয়েছে আতাহার ভাই?
কিছু হয় নিতো।
আমার ধারণা হয়েছে। আপনার গলার স্বর পালেট গেছে।
মনে হয়। ঠাণ্ডা লেগেছে।
না ঠাণ্ডা না— অন্য কিছু। আতাহার ভাই আপনার মা কেমন আছেন?
আতাহার জবাব দিল না। তার ইচ্ছা করছে টেলিফোনটা রেখে দিতে।
আতাহার ভাই?
হুঁ।
আপনার মা কেমন আছেন?
কেমন আছেন বলতে পারছিনারে। তাকে একটা হলুদ চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। শাদা চাদরে ঢেকে রাখা নিয়ম–মনে হয় এদের শাদা চাদর শেষ হয়ে গেছে।
আতাহার ভাই, আপনি কি হাসপাতালে?
হুঁ।
আমি আসছি।
তুই কি আমার জন্যে একমগ এসপ্রেসো কফি বানিয়ে আনবি? আমার খুব কফি খেতে ইচ্ছা করছে।
আমি কফি নিয়ে আসব।
তুই কি একটু সেজোগুজে আসবি নীতু? আমার খুব সুন্দর একটা মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে।
বাদ আছর আতাহার তার মাকে কবরে নামিয়ে দিল। রাত নটা পর্যন্ত এক একা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে হাঁটাল। দশটার দিকে সাজ্জাদের সঙ্গে গেল চানখার পুলের এক বাড়িতে। মজার কিছু দেখতে।
মজার ব্যাপারটা ঘটতে যাচ্ছে। আতাহার তাকিয়ে আছে। তার পেটের সবকিছু দিলা পাকিয়ে উঠেছে। সে অনেক কষ্টে ঘেন্না চেপে রাখছে। কতক্ষণ চেপে রাখতে পারবে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে শরীরের সমস্ত ঘেন্না বমি হয়ে বের হয়ে আসবে। দুৰ্গন্ধ বমিতে সে সমস্ত পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে। কারণ তার চোখের সামনে নোংরা কদৰ্য একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে।
সে এবং সাজ্জাদ বসে আছে একটা টিনের বাড়ির মেঝেতে। এই গরমেও বাড়ির সব কটা জানালা বন্ধ। তাদের সঙ্গে আরো তিনজন আছে, যারা ডাল-খোর। নেশার জগতে ফেসিডিলের আদরের নাম হল ডাল। যারা দৈনিক তিন-চার বোতল খায় তারাই ডাল-খোর। ডাল খাওয়া হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর আনন্দময় আবহাওয়া বিরাজ করছে। তিন ডাল-খোরের একজন এখন আরেকটি বিচিত্র নেশা করবে। আতাহার এবং সাজ্জাদ তার জন্যেই অপেক্ষা করছে। সে জ্যান্ত টিকটিকি খাবে। ডালের নেশা দু-তিন ঘণ্টার বেশি থাকে না। ডালের পর একটা জ্যান্ত টিকটিকি খেতে পারলে নেশাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। পৃথিবী নানা বর্ণে, নানা গন্ধে ধরা দেয়।
টিকটিকে যে খাবে তার নাম কুদ্দুস। সে এক কৃষি ব্যাংকের নাইট গার্ড। আজ তার অফ ডিউটি। সে মুখ-বন্ধ টিনের কোটায় টিকটিকি নিয়ে এসেছে। টিনের কোটার মুখ ফুটো করা আছে যাতে টিকটিকি মরে না যায়।
সাজ্জাদ। বলল, কৌটায় কয়টা টিকটিকি আছে?
কুদ্দুস হাসিমুখে বলল, তিন-চারটা আছে, গনতি নাই। বেশীও থাকতে পারে।
আপনি খাবেন কটা?
ভাইজান একটা খাব। বিষাক্ত জিনিস তো–বেশি খাইলে বাঁচনের উপায় নাই।
জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন?
জ্যান্ত খাওনের নিয়ম। খাওনের পর ডাইল দিয়ে কুলি করলেই সব হজম। তবে ভাইজান–টিকটিকির লেজের বিষয়ে সাবধান। টিকটিকির সব বিষ তার লেজে।
লেজ খাওয়া যায় না? তাও খাওয়া যায়। অনেক ঝামেলা আছে। লেজটারে প্রথম পুইড়া ছাই বানাইতে হয়। সেই ছাই সিগারেটের শুকার সাথে মিশাইয়া টানতে হয়।
আপনি টেনেছেন?
জ্বে-না, অত ঝামেলা পুষায় না।
আতাহার বলল, জ্যান্ত টিকটিকি খান, ঘেন্না লাগে না?
ঘিন্নার কি আছে? মাছ মাংস মানুষে খায় না? অত ঘিন্না করলে দুনিয়াতে বাঁচন যায় না। তাছাড়া ভাইজান, ডাইল-খোরের অত ঘিন্না থাকে না। এইটাই ডাইলের মজা। ডাইল খাইলে কোন কিছুতে ঘিন্না লাগে না। সবেরে বড় আপন লাগে। দুনিয়াটা যে রঙ্গিলা এইটা ডাইল না খাইলে বুঝা যায় না।