একটা চালতা গাছের কথা তার মনে পড়ল। তাদের মামার বাড়ির উঠোনে চালতা গাছটা ছিল। ঘন সারিবদ্ধ পাতার কি বিশাল গাছ। পাতাগুলি করাতের মত খাজকাটা। মে-জুন মাসে বড় বড় ফুল ফুটতো। শাদা ফুল। মোটা পুরুষ্ট পাপড়ি। কি অদ্ভুত সুগন্ধি ফুল! মেজো মামী একবার চালতার আঠা এনে তাঁর মাথায় মাখিয়ে দিলেন, এতে না-কি চুল উজ্জ্বল হবে। চুল উজ্জ্বল হয়েছিল কি-না তাঁর মনে নেই। কারণ তার দুদিন পরই তার মাথা কামিয়ে দেয়া হয় যাতে ঘন হয়ে চুল উঠে।
তিনি হাসপাতালের এই ঘরে চালতা ফুলে গন্ধ পেতে লাগলেন। মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও চালতা গাছ আছে। চালতা গাছ ছেয়ে ফুল ফুটেছে। তিনি আবারো ডাকলেন–রুনু, ও রুনু। তাঁর মন বলছে–রুনু নামের একজন কেউ পাশেই ঘুর ঘুর করছে। সে একটা পাতলা সুতির চাদর তাঁর কোমর পর্যন্ত টেনে দেবে। কঁচের ঝকঝকে পরিষ্কার গ্রাসে করে এক গ্রাস পানি এনে দেবে। তখন তিনি রুনুকে বলবেন, ও রুনু, তুই আমাকে কয়েকটা চালতা ফুল এনে দিতে পারবি? রাতের বেলা গাছ থেকে ফুল পাড়া নিষেধ। তবু তার খুব ইচ্ছা করছে বালিশের কাছে কয়েকটা ফুল রেখে দিতে।
কিশোরী বয়সে বালিশের কাছে ফুল রেখে ঘুমানোর অভ্যাস হয়েছিল। ফুলের গন্ধ নিয়ে ঘুমুতে গেলে সুন্দর স্বপ্ন দেখা যায়। সুন্দর স্বপ্ন দেখার লোভে রাতের পর রাত তিনি বালিশের পাশে ফুল নিয়ে ঘুমিয়েছেন।
একবার অদ্ভুত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেওছিলেন। কিশোরী বয়সের সেই স্বপ্নে একটা কিশোর ছিল। যার চোখ দুটি মেয়েদের মত জলেভরা। স্বপ্নে তিনি ছেলেটির সঙ্গে নানান ধরনের দুষ্টুমি করেছিলেন। সে কোন প্রতিবাদ করে নি। সারাক্ষণ মাথা নিচু করেছিল। এক একবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সে কেঁদে ফেলবে। তবু তিনি দুষ্টুমি বন্ধ করলেন না। দুষ্টুমি করতে তাঁর এত মজা লাগছিল। স্বপ্ন ভাঙ্গার পর তিনি অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তাঁর মনে হল–এই রকম সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে।
অবিশ্বাস্য মনে হলেও এরকম একটা ছেলের সাথেই তার বিয়ে হয়েছিল। কিশোরী বয়সের স্বপ্নের ব্যাপারটা তিনি অবশ্যি কোনদিনই তাঁর স্বামীকে বলেন নি। ছেলেমেয়েদেরও বলেন নি। আজ বলতে ইচ্ছে হচ্ছে— অথচ আজ কেউ পাশে নেই। রুনু মেয়েটা বোধ হয় আছে। তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি ডাকলেন, ও রুনু। রুনু।
রুনু জবাব দিল। অস্পষ্টভাবে বলল, হুঁ।
ও রুনু, ঘরের জানালা বন্ধ কেন? জানালা খুলে দিলে চালতা ফুলের গন্ধ আরো ভাল পাওয়া যেত।
কথাগুলি তিনি বললেন খুব স্পষ্টভাবে। তারপরই তাঁর তৃষ্ণা হঠাৎ বেড়ে গেল, শ্ৰবাসকষ্ট শুরু হল। সমস্ত শরীরে বিচিত্ৰ এক ধরনের ছটফটানি শুরু হল। তিনি আবারো ডাকলেন, ও রুনু। রুনু…..
একবারের জন্যেও তাঁর নিজের পুত্র-কন্যা, স্বামীর কথা মনে পড়ল না। পরিচিত পৃথিবীর কারোর কথাই মনে এল না। রুনু নামের একটি কাল্পনিক মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে, চালতা ফুলের গন্ধ শুকতে শুকতে তিনি যাত্রা করলেন–রহস্যময় এক জগতের দিকে। তিনি মারা গেলেন রাত তিনটায়।
আতাহার ভোরবেলা কখনো হাসপাতালে আসে না। সেদিন কি মনে করে যেন এল। মার ঘরে উকি দিল। বেডের উপর লম্বালম্বিভাবে হলুদ রঙের একটা চাদর বিছানো। সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রবল শোক তাকে আচ্ছন্ন করল না। বরং হঠাৎ নিজেকে খানিকটা মুক্ত বলে মনে হল। মনে হল, এই এতদিন পর বিবলিক্যাল কর্ড কাটা পড়ল। শিশুর জন্মের পর নাড়ি কেটে মার কাছ থেকে তাকে আলাদা করা হয়। তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় তুমি এখন আর তোমার মায়ের শরীরের কোন অংশ না। তুমি আলাদা একজন মানুষ। সত্যিকার অর্থে কিন্তু সেই নাড়ি কাটা পড়ে না। যতদিন মা বেঁচে থাকেন। ততদিন অদৃশ্য নাড়ির বন্ধন থাকে। বন্ধন কাটে মার মৃত্যুতে।
দীর্ঘদিনের অভ্যেসের কারণে আতাহার মনে মনে মাকে বলল, কি ব্যাপার মা, এরকম হুট করে চলে গেলে যে?
বলেই লজ্জা পেল। এমন গভীর বিষাদের সময় এ জাতীয় হালকা কথাবার্তা কি বলা চলে?
আতাহার ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে পুরোপুরি মুক্ত করার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ মা। তোমাকে ধন্যবাদ। একজন মানুষের সৃষ্টির প্রথম শর্ত হচ্ছে পূর্ণ মুক্তি। পুরোপুরি মুক্ত একজন মানুষই সৃষ্টি করতে পারে। সৃষ্টিকতাঁর সৃষ্টির মূল রহস্যই এইখানে–তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত।
হলুদ চাদর সরিয়ে মার মুখ দেখার কোন ইচ্ছা আতাহারের হল না। সে চাচ্ছে তার মনে জীবিত মানুষের মুখের স্মৃতিটিই থাকুক। মৃত মানুষের শীতল ছবি না।
আতাহার হাসপাতালের বারান্দায় এসে সিগারেট ধরাল। এটা অন্যায় একটা কর্ম। জায়গায় জায়গায় নোটিশ ঝুলছে ধুমপান মুক্ত এলাকা। আজকের দিনে সামান্য অন্যায় বোধ হয় করা যায়। তাকে ঠাণ্ডা মাথায় কিছুক্ষণ চিন্তা করতে হবে। সারাদিনের কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। মিলিকে খবর দিতে হবে। মিলি একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল–কোথায় আছে। সেই নাম্বার কে জানে। নিশ্চয়ই হারিয়ে গেছে। মনিকাকে টেলিফোন করতে হবে। খবর শুনে এরা দুজনই আকাশ ফাটিয়ে কাঁদবে। এদের কান্না শুনতে হবে।
মৃত্যু ব্যাপারটা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকার কোন উপায় কি আছে? মৃত্যু শোকে কাতর মানুষদের মৃত্যুশোক ভুলানোর জন্যে কোন ব্যবস্থা থাকলে ভাল হত–বিশেষ একটা টেলিফোন নাম্বার। যে নাম্ববারে ডায়াল করলেই সমবেদনায় আর্দ্র একটি কণ্ঠ বলবে,