নেংটো হয়ে সত্যি নাচানাচি করেছেন নাকি রে ভাই?
হ্যাঁ সত্যি করেছি।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ তো বটেই।
তাহলে এখন ঢাকা চলে যাচ্ছেন?
জ্বি।
পথে পথে নেংটো নাচ নাচব, বেশ্যার দালাল হব, কবিতা লেখব…
প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের মুখ হা হয়ে গেল। মজিদ নামের অতি ভদ্র, অতি বিনীত মানুষটা আজ কি ধরনের কথা বলছে? এ রকম একটা মাথা-খারাপ মানুষ মেয়েদের কলেজে এতদিন মাস্টারি করেছে? ভাবাই যায় না। এই লোককে তো অনেক আগেই পাগলা গারদে লোহার চেইন দিয়ে বেঁধে রাখা উচিত ছিল।
মজিদের জিনিসপত্র ওয়াদুদ সাহেবের বাড়িতে। সে ঢাকা থেকে আসার সময় একটা সুটকেস নিয়ে এসেছিল। এখন অল্প অল্প অনেক কিছু হয়েছে। লেপ, তোষক, কম্বাবল, চাদর, বালিশ। এইসব নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। এখানে আসার সময় একটা সুটকেস নিয়ে এসেছিল, একটা সুটকেস নিয়েই তার ফিরে যাওয়া উচিত। সন্ন্যাসীরা বলেন–আসছি নেংটা, যামু নেংটা। পৃথিবীতে আমরা নগ্ন হয়ে আসি, পৃথিবী থেকে ফিরেও যাই নগ্ন হয়ে।
মজিদ সুটকেস গুছালো–কয়েকটা শার্ট-পেন্ট আর এক তোড়া কাগজ, যার সাদা শরীরে কবিতা লেখা হয়েছে। সবই প্রেমের কবিতা। জনৈকা নৈঃশব্দদ্বতীকে নিয়ে লেখা। তার এই জীবনের সঞ্চয়। লেপ, তোষক, কাঁথা বালিশ পড়ে থাকুক। এইগুলি কোণ সঞ্চয় নয়।
যাবার আগে নৈঃশব্দবতীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। তাকে সহজ, গলায় যদি বলা যেত–
শোন নৈঃশব্দবতী, তুমি থেকে সুখে।
তুমি থেকে চন্দ্ৰ-শাদা দুধের সায়রে।।
কিছুই বলা যাবে না। যাবার আগে দেখা হবে না। মজিদের গলার কাছে দলা পাকাতে লাগল। দুঃখের এই অনুভূতি তার শৈশবে হত। আর কখনো হয়নি। আবারো অনেক অনেকদিন পরে হল। কি হাস্যকর ব্যাপার! বায়বীয় দুঃখ জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়। গলার কাছে এসে আটকে থাকে।
গোছগাছে সাহায্য করার জন্যে নসু। এসেছে। দড়িদাড়া নিয়ে সে প্রবল উৎসাহে তোষক বাঁধতে শুরু করেছে। মজিদ বলল, নসু, এইসব আমি নেব না।
নসু অবাক হয়ে বলল, নিবেন না?
না।
এইগুলো কি করবেন?
তুমি নিয়ে যাও।
আমি নিয়ে যাব?
হ্যাঁ–লেপ-তোষক, বিছানা-বালিশ সব নিয়ে যাও। আর শোন, তুমি জাহেদাকে বলবে সে যেন ভালমত পড়ে।
জ্বি আচ্ছা।
বলবে কিন্তু মনে করে।
অবশ্যই বলব। এখন বইল্যা আসি?
না, এখন বলতে হবে না। আমি চলে যাবার পরে বলবে।
জে আইচ্ছা।
আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবে নসু?
অবশ্যই খাওয়াব। পানি খাওয়ামুনা এইটা কেমন কথা?
নসু পানি আনতে গেল। মজিদ সিগারেট ধরাল। এই বাড়িতে তার শেষ সিগারেট। সিগারেটের ছাই ফেলে সে চলে যাবে। উইড়া যায়রে বনের পক্ষী পইড়া থাকে মায়া।
উইড়া যাবে আবদুল মজিদ,
পইড়া থাকবে ছাই।
পানি নেন।
মজিদ চমকে তাকাল। পানির গ্লাস নিয়ে নসু। আসেনি, এসেছে জাহেদা। সে অন্যান্য দিনের মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে নেই। সে তাকিয়ে আছে মজিদের চোখের দিকে। পানির গ্লাসও ঠিক করে টেবিলে নামিয়ে রাখল না। গ্রাস হাতে নিয়েই সে দাঁড়িয়ে আছে।
আজ পানির গ্রাস তার হাত থেকেই নিতে হবে।
কেমন আছ জাহেদা?
ভাল।
জাহেদার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। আশ্চর্য! মেয়েটার চোখ এত সুন্দর।
পানি নিন। কতক্ষণ গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকব?
মজিদ পানির গ্লাস নিল। তার তৃষ্ণা চলে গেছে। তারপরেও এক চুমুকে পানির গ্লাস শেষ করল। জাহেদা বলল, স্যার, বাবা আপনার সম্পর্কে যা বলেছে তা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
এইসব আর করবেন না।
না, আর কোনদিন করব না।
আমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করুন।
মজিদ বিস্মিত হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। কি বলছে এই মেয়ে?
জাহেদার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। মেয়েরা তাদের অশ্রু অন্যদের দেখাতে চায় না, প্রিয়জনদের তো কখনোই না। কিন্তু জাহেদা তার চোখ নিচু করছে না। সে তাকিয়েই আছে।
আপনি কোথাও যাবেন না। এই বাড়িতেই থাকবেন। আমি বাবাকে বলেছি।
বাবা তোমার কথা শুনবে?
হ্যাঁ শুনবে। কই, আপনি তো আমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করছেন না।
মজিদ হাত বাড়াতেই নৈঃশব্দবতী তাকে জড়িয়ে ধরল। এ কি অদ্ভূত কাণ্ড! দরজা খোলা, জানালা খোলা, লোকজন আসা-যাওয়া করছেন। নৈঃশব্দবতী কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
মজিদ তার খাটে বসে আছে। তার হাতে একগাদা কাগজ। তার সারা জীবনে লেখা প্রতিটি কবিতা এই কাগজের তাড়ায় লেখা আছে। মজিদ বসে বসে কাগজগুলি ছিঁড়ে কুচি কুচি করছে। একটি প্রিয় জিনিস পেতে হলে অন্য একটি প্রিয় জিনিস ছাড়তে হয়। সে আজ থেকে কবিতা ছাড়ল। কবিতাকে তার আর প্রয়োজন নেই।
সালমা বানু চোখ মেললেন
সালমা বানু চোখ মেললেন। ঘর আলো হয়ে আছে। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তবু কিছুই যেন ঠিক স্পষ্ট না। নতুন চশমা পরলে চারপাশ যেমন এলোমেলো লাগে–তেমন লাগছে। সব কেমন যেন আঁকা বাঁকা। মাথার উপরের ছাদ মাঝখানে খানিকটা যেন নেমে এসেছে। তিনি কোথায়? হাসপাতালে? হাসপাতালে যদি হন। তাহলে ঘরটা চিনতে পারছেন না কেন? তার তৃষ্ণা বোধ হল। প্রবল তৃষ্ণা না–হালকা ধরনের তৃষ্ণা। ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি কেউ তার হাতে দিলে তিনি ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে গ্লাসটা শেষ করতেন। ঢাক ঢক করে না। ঢাক ঢক করে পানি খাওয়ার মত তৃষ্ণা তার হয়নি। আরামদায়ক তৃষ্ণা। যে তৃষ্ণা নিয়ে রাতে ঘুমুতে যাওয়া যায়। ঘুমের অসুবিধা হয় না।
তিনি সাবধানে মাথা কাত করলেন। তার কাছে মনে হচ্ছিল কে যেন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল না। পুরো ঘরটা ফাঁকা। তাঁর একটু ভয় ভয় লাগল। তিনি ডাকলেন, রুনু, ও রুনু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে রুনু নামের কাউকে তিনি চেনেন না। হঠাৎ এই নামটা কেন তাঁর মাথায় এল তিনি জানেন না। তার শীত শীত করছিল। কেউ যদি একটা পাতলা সুতির চাদর তাঁর কোমর পর্যন্ত টেনে দিত। এটা কোন কাল? শীত কাল? আশ্বিনের শেষ ভাগ? আশ্বিনের শেষ ভাগে গায়ে হালকা সুতির চাদর দিতে হয়।