আতাহার বলল, আমরা জোছনা দেখতে এসেছি, না কবিতার পরীক্ষা দিতে এসেছি?
সাজ্জাদ বলল, মজিদ, তুই বল। তুই পারবি।
মজিদ বলল, অশ্বত্থে হবে না, শব্দটা অশথে। জীবনানন্দ ইচ্ছে করে ভুল বানান ব্যবহার করেছেন।
একসেলেন্ট। তোর মত একজন কবি গ্রামে এসে গৃহপালিত কুকুর হয়ে গেলি–এই দুঃখ আমার রাখার জায়গা নেই। আমি এসেছি তোকে উদ্ধার করতে।
আমাকে উদ্ধার করতে হবে মা
সাজ্জাদ ব্যাগ খুলে পেটমোটা একটা বোতল বের করল। মজিদ আঁতকে উঠে বলল, অসম্ভব, মদ খেয়ে ঐ বাড়িতে যেতেই পারব না।
সাজ্জাদ বলল, ঐ বাড়িতে যাবার দরকার কি? কোন দরকার নেই। আমরা সারারাত জোছনা দেখব। পায়ে গু মাখব। ভোরবেলা সুবোধ বালকের মত ঢাকা চলে যাব।
মজিদ বলল, পাগলের মত কথা বললেই হল? আমাকে গলা টিপে ধরলেও আমি এক ফোঁটা মদ খাব না।
এটা মদ না।
মদ না তো কি?
সিদ্ধির সরবত। পেস্তা বাদাম, ধুতরার পাতা দিয়ে অনেক ঝামেলা করে ঢাকা থেকে বানিয়ে এনেছি। নিধুবাবু নামের জনৈক এক্সপট বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি কালীপূজা ছাড়া সিদ্ধির সরবত বানান না। আমার বিশেষ অনুরোধ এবং বিশেষ অর্থ ব্যয়ের কারণে বানিয়েছেন। এই সিদ্ধির সরবত খাইয়ে–আজ তোর সিদ্ধিলাভ ঘটাব।
মজিদ বলল, অসম্ভব!
আতাহার বলল, ও খেতে চাচ্ছে না, ওকে জোর করে খাওয়ানোর দরকার কি?
সাজ্জাদ বলল, আচ্ছা থাক, আমি একাই খাব। আমি এই জোছনা পুরোপুরি অনুভব করতে চাই।
সাজ্জাদ বোতল থেকে ঢকা চক করে অনেকখানি মুখে ঢািলল। মুখ মুছে বলল, তোরা গান শুনবি?
কেউ হ্যাঁ বা না বলার আগেই সাজ্জাদ। গান ধরল–
বাউলা কে বানাইল রে?
হাসন রাজারে বাউল কে বানাইল রে?
কিছু কিছু মানুষ বাউলা হয়ে পৃথিবীতে জন্মায়। কে তাদের বাউল বানায়? সে কে? কে?
টলমলে জোছনায় এই গান বাউলা শ্রেণীর মানুষদের বড়ই কাবু করে। বিচিত্র উপায়ে এই গান তাদের রক্তে ঢুকে যায়। এক সময় রক্তের লোহিত রক্তকণিকারাও গানে অংশগ্রহণ করে। তখন মানসিক সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
মজিদ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখি বোতলাটা। সে হাড়হড় করে অনেকখানি মুখে ঢেলে দিল। তারপর বোতলটা হাতে হাতে ঘুরতে থাকল। এই তিন যুবকের জন্যে চাঁদ অনেকখানি নিচে নেমে এল। সে তার জোছনাকে আরো তীব্র এবং একই সঙ্গে আরো কোমল করল।
মজিদ বলল, জোছনায় গোসল করলে কেমন হয়? গায়ের সব ময়লা জোছনায় ধুয়ে ফেলি। কি বলিস?
বাকি দুজন জবাব দিল না। মজিদ তার শার্ট-পেন্ট খুলে ফেলে পুরোপুরি নগ্ন হল। জোছনা সারা গায়ে ডলে ডলে স্নান শুরু করল।
রাত বাড়তে থাকল। সিদ্ধির সরবত তিন যুবককে অন্য জগতে নিয়ে গেল। যে জগতের সঙ্গে পৃথিবীর কোন যোগ নেই।
ওয়াদুদ সাহেব নসুকে সঙ্গে নিয়ে রাত দুটার দিকে তাদের খোঁজে এলেন। মফস্বলের মানুষ সব সময় হাতে টর্চ রাখে। তীব্র চাঁদের আলোতেও তারা টর্চ-হাতে চলাফেরা করে। ওয়াদুদ সাহেব টর্চের আলো ফেলে ডাকলেন, মজিদ! মজিদ!
মজিদ খিক খিক করে হাসল।
সেই হাসির শব্দে যে কেউ আতংকগ্ৰস্ত হবে। তিনিও হলেন। তিনি ভীত গলায় বললেন, মজিদ, কি হয়েছে?
মজিদ বলল, কিছু হয় নাই। আমার কিছু হয় নাই। কিছু হয় নাই।
বলেই সে ঝোপের আড়াল থেকে বের হল। হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগল ওয়াদুদ সাহেবের দিকে।
চাঁদের আলোয় নগ্ন একজন মানুষ হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে–এই ভয়ংকর দৃশ্য তিনি দেখলেন। নসু। দেখল। নসু বিড় বিড় করে কি যেন বলল। ওয়াদুদ সাহেবও বললেন। মজিদ আবারো খিকখিক শব্দ করে হাসল। পশুর গোংগানির মত শব্দ করে হাসতে তার খুব ভাল লাগছে।
নেত্রকোনা গার্লস কলেজ থেকে মজিদকে ছাটাই করা হয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বরখাস্তের চিঠিতে লিখেছেন–Your service is no longer required. চিঠিতে কোন কারণ দর্শনো হয়নি। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব মজিদকে তার নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে নিচু গলায় বলেছেন–বেসরকারি কলেজের চাকরি আর কারখানার মজুরের চাকরি এক রকম। মালিকের মজির উপর চাকরি। বুঝলেন ভাইসাহেব, আমাকে যে রকম লিখতে বলেছেন। আমি লিখেছি। আপনার মত একজন ভাল শিক্ষক চলে যাচ্ছে। আফসোসের ব্যাপার।
মজিদ বলল, না, ঠিক আছে।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, রুটি-রুজির মালিক আল্লাহ পাক। আপনি এইটা শুধু মনে রাখবেন। মানুষ রুটি-রুজির ব্যাপারে কিছু করতে পারে না। যা করার করেন উপরওয়ালা।
জ্বি।
এখন বলেন তো দেখি মজিদ ভাই ব্যাপারটা কি? ওয়াদুদ সাহেবের সঙ্গে আপনার গণ্ডগোলটা কি নিয়ে? আমাকে বলা আর গাছকে বলা এক কথা। কাকপক্ষী জানবে না। বলেন দেখি ব্যাপারটা কি?
মজিদ বলল, ব্যাপার কিছু না।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, আমাকে ইন কনফিডেনেস বলতে পারেন। একটা কানাঘুসা শুনছি–সমস্যাটা না-কি ওয়াদুদ সাহেবের মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের না-কি ঝামেলা হয়ে গেছে–রোজ সকালে বমি-টমি হচ্ছে?
ছিঃ ছিঃ, কি যে বলেন! সমস্যাটা–সম্পূর্ণই আমার, আমি বন্ধুদের সঙ্গে সিদ্ধির সরবত খেয়ে নানান পাগলামি করেছি। ওয়াদুদ সাহেব দেখেছেন।
সিদ্ধির সরবত?
হ্যাঁ–স্ট্রং হেলোসিনেটিং ড্রাগ।
ও।
নেংটো হয়ে নাচানাচি করেছি–হাসাহাসি করেছি।
নেংটো হয়ে নাচানাচি?
জ্বি।
সোবাহানাল্লাহ, কি বলেন? আমরা আরো উল্টা কথা শুনেছি। আমরা শুনেছি…।
আপনারা কি শুনেছেন তা আমি শুনতে চাচ্ছি না। বিদায় হচ্ছি। আপনারা ভাল থাকবেন।