মজিদ আঁতকে উঠে বলল, কি সর্বনাশের কথা!
আছে কিনা সেটা বল।
আছে তো নিশ্চয়ই। তবে কোথায় তা জানি না।
সাজ্জাদ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ওদের কয়েকটাকে ধরে এনে চল নদীর পাড়ে চলে যাই। চাঁদের আলোয় ধেই ধেই করে নোচানাচি করব।
পাগলের মত কথা বলিস না তো।
পাগলের মত কথা মানে? আজ রাতটা হবে নাইট অব দ্য পোয়েটস।
এখানে এসব সম্ভব না।
অবশ্যই সম্ভব। ইমপসিবল ইজ দ্যা ওয়ার্ড ফাউন্ড ওনলি ইন দ্যা ডিকশনারি অব ফুলস। তুই তো বোকা না। তোদের এখানে নদী আছে?
হুঁ।
ছোট না বড়?
ছোট। তবে এখন ভাল পানি আছে।
একসেলেন্ট। বজরা ভাড়া পাওয়া যাবে?
জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে ব্রথেলের মেয়েদের ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর কর।
মেয়ে ছাড়া নাইট অব দ্যা পোয়েটস হবে কি ভাবে? এ বাড়ির কোন মেয়ের সঙ্গে ভাব-টাব হয়নি? ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে নিয়ে চল।
মজিদ হড়বড় করে বলল, ওয়াদুদ সাহেবের কোন মেয়ে নেই। উনার দুই ছেলে। দোস্ত আরেকটা কথা, এই বাড়িতে কোন মদ খাওয়া-খাওয়ি হবে না। এরা অসম্ভব রকম কনজারভেটিভ।
সাজ্জাদ বলল, আমাদের মুখ থেকে মদের গন্ধ পেলেই ব্লগ কেটে ফেলবে?
প্রায় সে রকম। জোন-শুনে তুই এই জায়গায় পড়ে আছিস? ব্যাপারটা কি? তুই ঝেড়ে কাশ তো সোনামণি।
সোনামণি ঝেড়ে কাশতে পারল না। সে চাচ্ছে দ্রুত বন্ধুদের নিয়ে বের হয়ে পড়তে। মাগরিবের নামাজের পর ওয়াদুদ সাহেবের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে। মজিদ চাচ্ছে না তার বন্ধুদের সঙ্গে ওয়াদুদ সাহেবের দেখা হোক। সাজ্জাদের মুড ভাল থাকলে অসম্ভব ভদ্র ব্যবহার করবে। ওয়াদুদ সাহেব তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। মু্ড খারাপ থাকলে সে ওয়াদুদ সাহেবকেই হাসিমুখে বলবে, স্যার, কিছু মনে করবেন না–আপনাদের এখানকার ব্রথেলটা কোন দিকে?
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়–এই প্ৰবচন সত্য প্রমাণ করার জন্যেই–ওয়াদুদ সাহেবের সঙ্গে সবার দেখা হয়ে গেল। মজিদ চাপা আতংক নিয়ে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিল। সাজ্জাদের এসএসসি এবং অনার্সের রেজাল্টের কথা বলতে ভুলল না। ওয়াদুদ সাহেব বললেন, আপনারা এই সন্ধ্যাবেলা যাচ্ছেন কোথায়? বিশ্রাম করেন। খাওয়া-দাওয়া করেন।
সাজ্জাদ বলল, স্যার, আমরা গ্রামের জোছনা দেখতে এসেছি। রাতে খাওয়া-দাওয়া করব না।
ওয়াদুদ সাহেব বললেন, রাতে খাওয়া-দাওয়া করবেন না মানে? জোছনা খেয়ে পেট ভরে?
ঠিকমত খেতে পারলে জোছনা খেয়েও পেট ভরে। বেশিরভাগ মানুষ জোছনা খাওয়ার টেকনিক জানে না।
ওয়াদুদ সাহেব বিস্মিত হয়ে মজিদের দিকে তাকালেন। মজিদ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমরা চলে আসব। রাত একটু বেশি হবে কিন্তু চলে আসব।
যাচ্ছ কোথায়?
ওয়াদুদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, নদীর পাড়ে মানুষ হাঁটে? নদীর পাড় হল পায়খানা করার জায়গা।
সাজ্জাদ বলতে যাচ্ছিল–আমরা পায়ে গুং মাখার জন্যেই ঐদিকে যাচ্ছি। অনেকদিন পায়ে গু মাখা হয় না। মজিদের করুণ মুখ দেখে বলল, স্যার, আমরা খুব সাবধানে হাঁটব। আমার নাক কুকুরের নাকের মত। এক মাইল দূর থেকে গন্ধ পাই।
ওয়াদুদ সাহেব বললেন, আপনারা জোছনা দেখতে চান তো আমার একটা খামার বাড়ির মত আছে, সেখানে চলে যান না। সুন্দর বাগান আছে, টিনের একটা ঘর আছে, পাশ দিয়ে নদী গেছে। ইচ্ছা করলে নদীর পাড় ধরে হাঁটতেও পারেন।
সাজ্জাদ বা আতাহার কিছু বলার আগেই–মজিদ হড়বড় করে বলল, জ্বি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা।
নসুকে বলে দেই, নসু। তোমাদের নিয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা।
বেশি দেরি করবেন না। চলে আসবেন। একসঙ্গে খানা খাব।
আবারো মজিদ হড়বড় করে বলল, জ্বি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা।
সাজ্জাদ। বলল, স্যার, আপনি খেয়ে নেবেন। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন না। আমাদের খাওয়া ঢেকে রাখলেই হবে। আমরা কখন ফিরি ঠিক নেই। মজিদের সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা। পেট ভর্তি গল্প জমা হয়ে আছে।
বেশি দেরি না করাই ভাল।
রাত গভীর না হলে জোছনা ফুট না। জোছনা ফোঁটার জন্যে একটু দেরি স্যার হবেই।
ওয়াদুদ সাহেব বললেন, আপনি আমাকে স্যার স্যার বলছেন কেন?
আপনার আপত্তি থাকলে আর বলব না। চাচা ডাকব। চাচা, আমরা তাহলে যাই।
ওয়াদুদ সাহেব আরো হকচকিয়ে গেলেন।
গ্রামের চাঁদ শহরের চেয়ে কি আগে ওঠে? রাত বেশি হয়নি, এর মধ্যেই আকাশে বিশাল এক চাঁদ। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জোছনা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সাজ্জাদ বলল, জোছনার অবস্থাটা দেখেছিস?
সে কোন জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না
আসিবে না কখনো প্ৰভাতে
আতাহার বলল, বল দেখি কার লাইন?
আতাহার বলল, জী দাশ বাবুর লাইন।
এই কবিতার শেষ লাইন বলতে পারবি?
না।
মজিদ পারবে। কি রে মজিদ, তুই পারবি না?
মজিদ বিরস গলায় বলল, শেষ লাইন হচ্ছে–
অশ্বখের শাখা ঐ দুলিতেছে, আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।
একসেলেন্ট। কবিতাটার মজাটা কোথায় জনিস? আলো আসছে, ভোর হয়ে আসছে–এই দুঃখে কবি বিষন্ন। এখানেই কবির সঙ্গে আমার মিল। আমিও অন্ধকারের কবি।
মজিদ বলল, আমাদের এখন উঠা দরকার।
সাজ্জাদ বলল, এই কবিতাটা কেমন দেখ তো–
আকাশে চাঁদের আলো–উঠোনে চাঁদের আলো–নীলাভ চাঁদের আলো
এমন চাঁদের আলো আজ
বাতাসে ঘুঘুর ডাক–অশথে ঘুঘুর ডাক–হৃদের ঘুঘুর যে ডাক
নরম ঘুঘুর ডাক আজ।
এই কবিতায় আমি একটা ভুল করেছি–ইচ্ছা করে করেছি। ভুলের জন্যে মাত্রায় গণ্ডগোল হয় গেছে। বল দেখি আতাহার ভুলটা কি?