কি হইছে আম্মা?
কিছু না।
মতির মা এসে কপালে হাত রাখল। মতির মার হাতে হলুদ বাটার গন্ধ। মতির মা দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে তার সঙ্গে আছে। হলুদ বাটছে না। তারপরেও তার হাতে হলুদের গন্ধ কেন কে জানো! জর সামান্য আছে, ভয় পাবার মত কিছু না।
পানি খাব, মতির মা।
মতির মা বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢালছে। তার হাত কাঁপছে। ঘুম থেকে সে পুরোপুরি জাগেনি। কিংবা হঠাৎ ঘুম ভাঙার ভয় এখনো কাটেনি।
আজ কি বার মতির মা?
রবিবার। আম্মা, আপনের শইল খারাপ লাগতাছে? ডাক্তাররে খবর দিমু?
শরীর ঠিক আছে।
শরীর ঠিক আছে বললেও সালমা বানু বুঝলেন তাঁর শরীর ঠিক নেই। পানি খেতে তেতো লাগছে। অসুস্থ মানুষের কাছে পানি সব সময় তেতো বোধ হয়। পানি যার কাছে যত স্বাদু মনে হবে সে তত সুস্থ।
বাসার খবর কিছু জান মতির মা?
বাসার খবর ভাল আম্মা। ছোড অ্যাফা মন লাগাইয়া পড়তাছে।
পরীক্ষা শুরু হবে কবে?
হেইটা আম্মা জানি না।
সালমা বানু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা অনেক দিন তাঁকে দেখতে আসছে না। বোঝা যাচ্ছে পরীক্ষা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। কিংবা হয়ত এসেছে, এমন সময় এসেছে। যখন তিনি আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। মতির মা বলল, সক্কালে ছোট আফা আসছিল। আফনে ঘুমের মধ্যে ছিলেন আফনেরে জাগনা করে নাই। ডাক্তার জাগনা দিতে নিষেধ দিছে।
মিলি আছে কেমন?
খুব ভাল আছে।
আফনের জন্যে চিডি নিয়া আসছিল।
কোথায় চিঠি?
আফনের বালিশের নিচে আছে।
তিনি হাত বাড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে খাম বের করলেন। খামের মুখ খোলা হয়নি। এর আগেও মনিকার দুটা চিঠি এসেছে। দুটারই খামের মুখ খোলা ছিল। তিনি বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু কাউকে কিছু বলেন নি। একজনের চিঠি আরেকজন খুলবে কেন? মনিকা হয়ত এমন কিছু তাকে লিখতে চেয়েছে যা অন্যের জানা উচিত না। যা শুধু মাই জানতে পারেন।
মতির মা!
জ্বি আম্মা।
এইটো কি মাস?
এইটা হইল আম্মা ফালগুন। কিছু খাইবেন আম্মা?
না, কিছু খাব না। মাথার কাছের বাতিটা জ্বেলে দাও তো।
মাথার কাছে আম্মা কোন বাতি নাই। ঘরে একটাই বাতি।
তিনি আবারো নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি যে হাসপাতালে আছেন তা তার মনে থাকে না। প্রায়ই মনে হয় নিজের ঘরেই শুয়ে আছেন। তাঁর নিজের ঘরে মাথার কাছে একটা টেবিল ল্যাম্প আছে। বড় মেয়ের চিঠি গভীর রাতে মাথার কাছের এই টেবিল ল্যাম্প জ্বলিয়ে পড়েন। মেয়েটার কথা মনে করে তিনি তখন কিছুক্ষণ কাঁদেন।
মনিকা অবশ্যি গুছিয়ে চিঠি লিখতে পারে না। প্রয়োজনীয় কথার চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কথায় তার চিঠি ভর্তি থাকে। অসংখ্য খবর থাকে। সব খবর এলোমেলোভাবে লেখা। হাতের লেখাও খুব খারাপ। ঘরের কম আলোয় মনিকার চিঠি পড়া যাবে কিনা। তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি খাম খুললেন।
আম্মা,
আমার সালাম নিবেন। আমি এর আগে আপনাকে তিনটি চিঠি লিখেছি। কোন চিঠির জবাব পাই নাই। আপনার পক্ষে হয়ত জবাব দেয়া সম্ভব না। কিন্তু আপনার হয়ে অন্য কেউও তো জবাবটা দিতে পারে। মিলি তো পারে। মিলিকে আমি পৃথক চিঠি দিয়েছি, সে তারও জবাব দেয় নাই। আসলে আমার ব্যাপারে আপনাদের কারোরই কোন রকম আগ্রহ নাই। আমি বেঁচে থাকলেই কি? মারে গেলেই কি?
আপনার চিকিৎসার জন্য আমি বাবার ঠিকানায় দুশ ডলারের একটা ব্যাংক ড্রাফট পাঠিয়েছিলাম। আমি লিখে দিয়েছিলাম ব্যাংক ড্রাফটের প্রাপ্তি কথাটা যেন আমাকে না লেখা হয়। নিষেধ করার পরেও বাবা সেই কাজটা করেছেন। বিরাট চিঠি লিখে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এদিকে টাকাটা আমি আপনাদের জামাইকে না জানিয়ে পাঠিয়েছিলাম। সে বাবার লেখা চিঠি পড়ে খুব গভীর। আমাকে বলল–মার চিকিৎসার খরচ দিতে চাও খুব ভাল কথা। খরচ দিবে। মেয়ে মার অসুখের খরচ দিবে না তো কে দিবে? কিন্তু আমাকে জানিয়ে পাঠাতে অসুবিধা কি? আমি কি তোমাকে নিষেধ করতাম? তোমার মা তো আমারো মা।
এই হল মা আমার অবস্থা। ঢাকায় আমাদের ফ্ল্যাট বাড়িটা নিয়েও আপনার জামাইয়ের সঙ্গে সমস্যা হচ্ছে। আপনার জামাইয়ের ধারণা, ভাড়াটে ভাড়া ঠিকই দিচ্ছে–আমাদের মিথ্যা করে জানানো হচ্ছে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মা, আপনি ঐ ফ্ল্যাট বিক্রির ব্যবস্থা করে ওর নামে সোনালী ব্যাংকে যে একাউন্ট আছে সেই একাউন্টে টাকাটা জমা করে দিবেন। আমার ফ্ল্যাট বাড়ির দরকার নাই। তাছাড়া আপনার জামাই দেশে ফিরবে না। বিদেশেই স্থায়ী হবে।
ও নিজে বাবাকে এই বিষয়ে পৃথক চিঠি দিয়েছে। মা, আমি আপনাদের জন্যে সর্বদাই দুঃশ্চিন্তায় অস্থির থাকি। আতাহারকে আমেরিকা নিয়ে আসার চেষ্টা আমি করে যাচ্ছি। এখানকার পত্রিকায় প্রায়ই পাওয়া যায় আমেরিকান সিটিজেনশীপ পাওয়া বাংলাদেশের মেয়ের জন্যে পাত্ৰ খোজা হচ্ছে। আমি তার সব কটিতে যোগাযোগ করি। আতাহারকে বলেছিলাম তার কিছু রঙিন ছবি পাঠাতে। সে তার উত্তর দেয় নাই। আমি এমন কি অপরাধ করেছি যে, কেউ আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখে না?
আম্মা, আমি খুব মানসিক অশান্তির মধ্যেও আছি। তোমার নাতনী ফারজানা এখন এক কালো ছেলের সঙ্গে ডেট করছে। ছেলেটা দেখতে দানবের মত। যখন দরজার কড়া নাড়ে তখন মনে হয় দরজা খুলে পড়ে যাবে। এই হারামজাদা রোজ সন্ধ্যায় এসে ফারজানাকে ডেটিং-এ নিয়ে যায়। আমি বলে দিয়েছি। দশটার মধ্যে মেয়েকে বাসায় পৌঁছে দিতে। সে দিন এসেছে রাত তিনটায়। আমি খুব হৈ-চৈ করেছি। এতে ফারজানা আমার উপর বিরক্ত হয়ে বলেছে সে আমার সঙ্গে থাকবে না। আলাদা এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকবে। চিন্তা করেন অবস্থা! গরিলার মত ছেলের মধ্যে সে কি দেখেছে একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। কি বিপদে যে আমি পড়েছি! একদিকে আপনার জামাই, অন্যদিকে ফারজানা আম্মা, আপনি অবশ্যই নফল নামাজ পরে ফারজানার জন্যে দোয়া করবেন। যেন দৈত্যাটার হাত থেকে মেয়েটা উদ্ধার পায়।