জাহেদা দেখতে এল না। শুধু তাই না, পরের দিন পড়তে এসে একবারও জিজ্ঞেস করল না–স্যার, আপনার শরীর এখন কেমন?
মেয়েটা যদি কথাবার্তা বলতো তাহলে অনেক মজা করা যেত। মজিদ কয়েক লাইন কবিতা মেয়েটার হাতে দিয়ে বলত–
জাহেদা–কবিতাটা মন দিয়ে পড়ে আমাকে বল অর্থ কি?
জাহেদা মাথা ঝাঁকিয়ে বলত, আমি পারব না। স্যার।
না পড়েই বললে পারব না। এটা তো ঠিক না। আগে পড়, খুব মন দিয়ে পড়।
জানি না ওপাশে কে আছে।
হেসে হেসে কি কথা সে কয়?
দাঁড়ায় না পায় শুধু ভয়।
কবিতাটার তো স্যার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
মন দিয়ে পড়ছ না। মন দিয়ে পড়লেই বুঝতে।
হাজারো মন দিয়ে পড়লেও কিছু বুঝব না। আপনি বুঝিয়ে দিন।
প্রতিটি বাক্যের প্রথম অক্ষরটা নিয়ে দেখা কি হয়? প্রথম বাক্যের প্রথম অক্ষর জা, দ্বিতীয়টার হে, তৃতীয়টার দা। কি হল?
আপনার মাথা হল।
স্যারের সঙ্গে এ আবার কি ধরনের কথা?
স্যারেরই বা কি ধরনের কোণ্ড। ছাত্রীকে নিয়ে কবিতা লেখা! তাও যদি ঠিকমত হত। দাঁড়ায় বানান হল চন্দ্রবিন্দু দিয়ে–তাহলে নামটা হয় জাহেদাঁ। মনে হচ্ছে ভূতের নাম।
তোমার নামটা এরকম যে সুন্দর কবিতা হয় না।
তাহলে আমাকে আপনার পড়ানো দরকার নেই। এমন কাউকে পড়ান যার নাম দিয়ে সুন্দর কবিতা হয়।
জাহেদা ঝটি করে উঠে দাঁড়াল। মজিদ হাত ধরে তাকে বসাতে গেল। শক্ত করে হাত ধরতে গিয়ে কাঁচের চুড়ি একটা ভেঙে গেল। গল গল করে রক্ত পড়তে লাগল। মজিদ বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, ইশ! হাত কেটেছে!
জাহেদা বলল, হাত কাটুক। কিন্তু আমার চুড়িটা যে ভেঙেছে তার কি হবে? এত শখ করে কাচের সবুজ চুড়ি কিনেছি। আপনি কি জানেন–সবুজ চুড়ি পাওয়া যায় না? আপনি কি কিনে দিবেন। সবুজ চুড়ি?
এইসব হাস্যকর পরিকল্পনা মজিদ কেন করে সে জানে না। জাহেদা হাতে কাচের চুড়ি পরে না। তার হাত ধরার কলম্পিনাটা তো ভয়াবহ। একবার জাহেদার হাত থেকে কলম নেবার সময় হাতে হাত লেগে গিয়েছিল। এতে জাহেদা যেভাবে চমকে উঠে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তা দেখে মজিদর প্রায় দুদিন মন খারাপ ছিল। এরপর থেকে কলমের দরকার হলে সে বলে, জাহেদা, কলামটা দাও তো। জাহেদা কলম দেয়। তবে হাতে দেয় না, তার সামনে টেবিলে নামিয়ে রাখে। তখন মজিদের নিজেকে খুব তুচ্ছ, খুব ক্ষুদ্র মনে হয়–ইচ্ছে করে ওয়াদুদ সাহেবকে বলে, আপনার নৈঃশব্দদ্বতী কন্যাকে আমি পড়াব না। তার জন্যে অন্য মাস্টার রাখুন। সবচে ভাল হয় যদি মাস্টারের বয়স ৮০-র উপরে হয় এবং মাস্টার সাহেবের দুটা হাত হয় কাঠের।
এই জাতীয় কথা কখনো বলা হয় না। মজিদ সন্ধ্যার পর থেকে তীব্র আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে–কখন আসবে জাহেদা। এক পলক তার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসবে চেয়ারে, পরবর্তী দেড় ঘণ্টা সেই মাথা সে আর উঁচু করবে না।
মজিদ তার ছাত্রীর জন্যে অপেক্ষা করছিল। জাহেদা আসতে দেরি করছে। মজিদের বুক ধড়ফড় করতে লাগল— আজ আবার কোন কারণে সে আসা বাদ দেবে না। তো? কাজের মেয়েটা এসে বলবে না তো–রাঙ্গা আফা আইজ পড়ব না।
না, তা হবে না। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মজিদ পায়ের শব্দে কাউকে চিনতে পারে না–শুধু একজনকে পারে। এটাও কি খুব আশ্চর্য ব্যাপার না? বাংলাদেশের দশ কোটি মানুষ হেঁটে গেলে সে বলতে পারবেনা কে হেঁটে যাচ্ছে–শুধু জাহেদা হেঁটে গেলে বলতে পারবে। এই আশ্চর্য ব্যাপারটা কোনদিন মেয়েটি জানবে না–এই ট্রাজেডির কোন তুলনা হয়?
জাহেদা চেয়ারে এসে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নসু। এসে বলল, ঢাকা থাইক্যা আফনের দুই বন্ধু আসছে–নাম বলছে সাজ্জাদ আর আতাহার।
দুজনই মজিদের অতি প্রিয়জন। অনেক দিন সে তাদের দেখে না, আনন্দে মজিদের লাফিয়ে উঠা উচিত। কিন্তু মজিদের মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। তার ইচ্ছা করল সে চিৎকার করে বলে–এদের চলে যেতে বল! এদের আমি চিনি না।
মজিদ জাহেদার দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আমি পড়াব না। কাল বেশি করে পড়াব। কেমন?
নৈঃশব্দদ্বতী কথা বলল না, শুধু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
সাজ্জাদ। বলল, কিরে মজিদ, তোকে এ রকম লাগছে কেন?
কি রকম লাগছে?
তোর কি যেন হয়েছে–তোর মধ্যে ঘর-জামাই ঘর-জামাই ভাব চলে এসেছে।
মজিদ হাসল। তবে ঠিকমত হাসতেও পারল না। হাসিটা কেমন যেন ঠোঁটের কোণায় ঝুলে রইল।
সাজ্জাদ বলল, বোকার হাসি কবে থেকে শিখলি? ও মাই গড়! কি অদ্ভূত করে হাসছিস! হয়েছে কি?
কি আবার হবে?
ঝেড়ে কোশ তো। ঝেড়ে কাশ।
কফ থাকলে তবে না ঝেড়ে কাশব–কফ নেই।
সাজ্জাদ আতাহারের দিকে তাকিয়ে বলল, আতাহার, বল তো ঠিক করে ওকে
কেমন লাগছে?
ওকে গৃহস্থের মত লাগছে।
মজিদ আবারো হাসল। সে এখনো ধাতস্থ হতে পারেনি। তবে বন্ধুদের দেখে এখন আনন্দ হচ্ছে। রক্তে পুরানো স্মৃতি জেগে উঠেছে। একে বোধ হয় বলে রক্ত উজানে যাওয়া।
মজিদ বলল, তোদের পরিকল্পনা কি?
সাজ্জাদ বলল, তোকে নিয়ে ফুল-মুন দেখব।
আজ ফুল-মুন না-কি?
আতাহার বলল, আজ ফুল-মুন নাকি তাও জানিস না? তোর হয়েছে কি? তুই কি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিস?
উহুঁ।
অবশ্যই ছেড়ে দিয়েছিস। তোকে দেখেই মনে হচ্ছে তুই বর্তমানে মফস্বলি অধ্যাপক। আজ রাতের জন্যে অধ্যাপকী খোলসটা ঝেড়ে ফেলে দে।
মজিদ শংকিত গলায় বলল, ঝেড়ে ফেলে কি করব?
সাজ্জাদ বলল, আমরা ত্রিমূর্তি বোহেমিয়ান জীবনে ফিরে যাব। তোদের এখানে ব্রথেল আছে না?