আতাহার ভাই, আপনি যান।
আতাহার চলে গেল। পরের তিন মিনিট নীতু ব্যাকুল হয়ে কাঁদল। চিঠিটা লেখার চেষ্টা করল। আসলেই সে এখন আর চিঠি নিয়ে এগুতে পারছে না। নীতু ঠিক করল, চিঠি না, যা বলার সরাসরি বলাই ভাল। আজ বলাই ভাল। আতাহার ভাইকে সে ছাদে ডেকে নিয়ে যাবে, তারপর এতদিনকার জমানো কথা সব বলবে। কাঁদতে কাঁদতে বলবে। নীতু বাথরুমে ঢুকে চুল আচড়াল। অসুস্থ অবস্থায় মুখে পাউডার দিতে নেই–তারপরেও মুখে হালকা করে পাউডার দিল। ঠোঁট ফ্যাকাসে হয়ে আছে। হালকা করে একটু লিপস্টিক কি দেয়া যায় না? এমন হালকা করে দেয়া যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে। টিপের পাতাটা শেষ হয়ে গেছে। রোজ ভাবে আনাবে–আনানো হয় না। আজ একটা কাগজের উপর বড় বড় করে লিখবে টিপা, তারপর সেই কাগজটা আয়নার উপর স্বাকচ টেপ দিয়ে লাগিয়ে দেবে, যাতে ভোরবেলা ঘুম ভেঙে আয়নার দিকে তাকালেই মনে পড়ে–টিপ কিনতে হবে।
নীতু নিচে নেমে এসে শূনল, আতাহার এবং সাজ্জাদ রাতের ট্রেনে নেত্রকোনা যাবে বলে বের হয়ে গেছে।
আবদুল মজিদ
ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক আবদুল মজিদের ছাত্রীমহলে ভাল সুনাম আছে। ইনি ভাল পড়ান। ক্লাস ফাঁকি দেন না। ছাত্রীদের সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করেন না। ছাত্রীদের যখন পড়া জিজ্ঞেস করেন, তাদের চোখের দিকে তাকিয়েই করেন, কখনো তাদের বুকের উপর চোখ রেখে করেন না।
ছাত্রীরা আবদুল মজিদ সাহেবের কাব্যপ্রতিভার কিছু জানে না। দুৰ্দান্ত এই আধুনিক কবি, যাঁর একটি কবিতার নাম–
(ইশ্বর)১/৩ x (মৃত্যু)২/৩ = ০
প্রকাশিত হবার পর যে মোটামুটি হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে ছাত্রীরা অজ্ঞ।
ছাত্রীদের এই সম্মানিত শিক্ষক প্রতি শুক্রবারে জুমার নামাজ আদায় করতে যান। কারণ তিনি থাকেন ওয়াদুদ সাহেবের বাড়িতে। ওয়াদুদ সাহেব গার্লস কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এই অঞ্চলের ধনবান এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি। ওয়াদুদ সাহেবের নেক নজর লাভ করা ভাগ্যের কথা। আবদুল মজিদ তা লাভ করেছে। ওয়াদুদ সাহেব মজিদকে থাকার জন্যে নিজের বাড়ির একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। মজিদের জন্যে তার বাড়ির ভেতর থেকে খাবার পাঠানো হয়। বিনিময়ে মজিদকে ওয়াদুদ সাহেবের তৃতীয়া কন্যা জাহেদা খাতুনকে ঘন্টাদুই করে পড়াতে হয়। জাহেদা খাতুন। এই বৎসর ইন্টারমিডিয়েট দেবে। সে পড়াশোনায় ভাল। এসএসসি-তে স্টার পেয়েছে। ইটারমিডিয়েটেও ভাল করবে।
জাহেদা খাতুন দেখতেও সুন্দর। কাটা কাটা চোখ-মুখ। মাথা ভর্তি চুল। স্যারের কাছে পড়তে যখন আসে তখন বেশ সেজোগুজে আসে। যেমন–চোখে কাজল থাকে। মেয়েটি খুবই শান্ত, চোখ তুলে তাকায় না বললেই হয়। আবদুল মজিদ যখন বলে–বুঝতে পারছ? জাহেদা তখন এত দ্রুত মাথা নাড়ে যে, মাজদের মনে হয় মেয়েটার মাথা বোধহয় শরীর থেকে ছিড়ে পড়ে যাবে। তার একেকবার বলতে ইচ্ছে করে–জাহেদা, এ রকম করে মাথা ঝাকিও না। মাথা ঘােড় থেকে খুলে পড়ে যাবে। তুমি কন্ধকাটা হয়ে যাবে। মজিদ বলে না, কারণ তার ধারণা মেয়েটা রসিকতা বুঝবে না। এই জাতীয় কোন কথা বললে কেঁদে-টেদে একটা কাণ্ড করবে। মূর্তির মত একটা মেয়েকে পড়াতে ভাল লাগার কথা না, কিন্তু মজিদের ভাল লাগে।
শুক্রবার ছুটির দিন। জাহেদা শুক্রবারে পড়তে আসে না। এইদিন বিকেলের পর থেকে মজিদের খুব অস্থির লাগে। নিজের উপর রাগ লাগতে থাকে। যদিও রাগ লাগার কোনই কারণ নেই। সাপ্তাহিক ছুটি তো থাকবেই। একদিন পড়তে না এলে কি হয়? শুক্রবার ছাড়াও মেয়েটা অন্যান্য দিন হঠাৎ হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই পড়তে আসে না। মজিদ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ভেতর বাড়ি থেকে মেটাসোটা একটি কাজের মেয়ে এসে বলে, রাঙ্গা আফা আইজ পড়ত না।
মজিদ গম্ভীর মুখে বলে, আচ্ছা। বলার পরেও সে নিজের চেয়ারে বসে থাকে। তার উঠে যেতে ইচ্ছো করে না। পরীক্ষার আগে আগে এরকম কামাই দেবার মানে কি? একদিন সে জাহেদাকে বলল–
শোন জাহেদা, কোন কারণ ছাড়া হুট করে পড়া বন্ধ করবে না। পরীক্ষা ঘাড়ের উপর চলে এসেছে। এই সময় পড়া বন্ধ করবে না। মনে থাকবে?
জাহেদা তার স্বভাবমত প্রবল বেগে মাথা বঁকিয়েছে।
শুক্রবারে তুমি আস না এটাও ঠিক না। আমি তো আর অফিস খুলে বসিনি যে শুক্রবারে অফিস ছুটি। আমি যখন আছি তখন তোমার পড়তে আসার সমস্যা কি? এরপর থেকে শুক্রবারেও আসবে।
জাহেদা আবার মাথা নেড়েছে। তার সেই বিখ্যাত মাথা নাড়া। মনে হচ্ছে মাথা ছিঁড়ে যাবে।
জাহেদা শুক্রবারে পড়তে আসেনি। শুধু শুধুই মজিদ অপেক্ষা করেছে। শেষে মেজাজ এত খারাপ হয়েছে যে, রাতে যখন নসু। নামে কাজের ছেলেটা ভাত নিয়ে এসেছে তখন বলেছে–ভাত নিয়ে যাও। ভাত খাব না।
নসু বলেছে, খাইবেন না ক্যান?
শরীর ভাল না। মনে হয় জ্বর।
রুটিপিঠা খাইবেন?
কিছুই খাব না। তুমি এইসব নিয়ে যাও তো।
নসূ টিফিন কেরিয়ার নিয়ে চলে গেল। মজিদের ক্ষীণ সন্দেহ হল, জ্বরের কথা শুনে হয়ত জাহেদা তাকে দেখতে আসবে। দেখতে আসাটাই স্বাভাবিক। সে তার শিক্ষক। যথেষ্ট যত্ন নিয়ে তাকে সে পড়াচ্ছে। সেই শিক্ষকের শরীর খারাপ, জ্বর। জ্বর বেশি বলেই রাতের খাবার খায়নি। এ রকম অবস্থায় সাধারণ ভদ্রতা হচ্ছে ছাত্রীর এসে খোঁজ নেয়া।
মজিদ গরমের মধ্যেই একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিল। জাহেদা যদি এসে দেখে সে হাফ শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুরছে তাহলে সে কি ভাববে?