আতাহার টাকাটা খরচ করল না। রাতের খাওয়াটা সে সাজ্জাদের বাসায় সারাতে পারে। খাওয়ার পর সাজ্জাদকে নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে চলে আসা। তাছাড়া এমিতে নীতুকে দেখার জন্যে হলেও তার যাওয়া দরকার। নীতুর জ্বর বেড়েছে। দেখতে যাওয়া উচিত। দুদিন পর পর মেয়েটা অসুখে পড়ছে। বিয়ের আগে এত অসুখ-বিসুখ হলে বিয়ের দিন তাকে তো পুরোপুরি পেত্নীর মত লাগবে।
নীতু তার খাটে শুয়ে আছে। তার গায়ে হালকা খয়েরি রঙের একটা চাদর। তার ঘরের বাতি নেভানো। শুধু মাথার পাশের সাইড টেবিলে টবিল ল্যাম্প জ্বলছে। সাইড টেবিলের পাশে এক গাদা কলা, কয়েকটা বেদান এবং পলিথিনের ব্যাগে এক কেজির মত কালো আঙ্গুর। কামাল এইসব ফল-মূল নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই নীতুকে দেখে গেছে। সে প্রায় এক ঘণ্টার মত ছিল। এই এক ঘণ্টা সে নীতুর হাত ধরে বসেছিল। এখন কামাল নেই। কামাল যে চেয়ারে বসেছিল। সেই চেয়ারে বসে আছেন হোসেন সাহেব। তিনিও নীতুর হাত ধরে বসে আছেন। নীতু ভাবছে–একেকজন মানুষ হাত ধরলে একেক রকম লাগে কেন? বাবা হাত ধরামাত্র তার সারা শরীরে প্রবল এক শান্ত ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। মা যদি কোন এক অলৌকিক উপায়ে হঠাৎ উপস্থিত হতেন এবং তার হাত ধরতেন তাহলে নিশ্চয়ই অন্য রকম লাগত।
হোসেন সাহেব বললেন, শরীরটা এখন কেমন লাগছে রে মা?
নীতু বলল, ভাল।
তোকে যে জিনিসে ধরেছে তার নাম ভাইরাস, অন্য কিছু না। ভাইরাস ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে। মিউটেশনের ফলে ভাইরাস চেঞ্জ হচ্ছে–ক্ৰমেই বদলাচ্ছে। এন্টিবায়োটিক ভাইরাসের উপর কাজ করে না, এ হচ্ছে আরেক সমস্যা। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
ভাইরাস জাতীয় সংক্রমণে প্রধান অষ্ণুধ হচ্ছে রেস্ট। রিল্যাক্সেশন এবং প্রচুর ভিটামিন-সি। গ্রাসভর্তি লেবুর সরবত খাবি, কমলার রস খাবি–দেখবি ভাইরাস কাবু হয়ে পড়ছে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী লিনাস পলিং ভাইরাস বিষয়ে একটা চমৎকার কথা বলেছেন…
নীতু বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বাবা, ভাইরাসের গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে না।
হোসেন সাহেব বললেন, ভাইরাসের গল্প শুনতে না চাইলে কি গল্প শুনতে চাস?
কোন গল্পই শুনতে চাই না। তুমি চুপচাপ আমার হাত ধরে বসে থাক।
আচ্ছা। ঠিক আছে। বসে থাকলাম।
হোসেন সাহেব এক নাগাড়ে বেশিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না। তিনি উসখুসি করতে লাগলেন। লিনাস পলিং-এর ভাইরাস ব্যাখ্যা তিনি কিছুক্ষণ আগে এনসাইক্লেপেডিয়া ব্রিটানিকা থেকে পড়ে এসেছেন। নীতুকে শোনাবার জন্যেই পড়া। মনে হচ্ছে পড়াটা জলে গেল।
নীতু বলল, বাবা, তোমাকে এখন খুব জরুরী একটা কথা বলি?
হোসেন সাহেব বললেন, বল।
কথাটা শুনে তুমি আপসেট হয়ে না, ঘাবড়েও যেও না।
হোসেন সাহেব শংকিত গলায় বললেন, কথাটা কি?
আমি কামাল সাহেব নামের এই মানুষটাকে বিয়ে করব না।
কি বলছিস তুই?
আমি যা বলছি খুব ভেবেচিন্তে বলছি। আরো অনেক আগে বলা উচিত ছিল। আই এ্যাম সরি যে আগে বলিনি।
চিঠিপত্র সব দিয়ে দিয়েছি।
তাতে কি হয়েছে?
কামালকে কি বলব?
বলবে যে আমার মেয়ের ধারণা তুমি মহা লোভী একজন মানুষ। আমার মেয়ে লোভী মানুষ পছন্দ করে না।
আমার ধারণা অসুখ-বিসুখে তোর মাথাটা ইয়ে হয়ে গেছে।
আমার মাথা ইয়ে হয়নি। মাথা ঠিক আছে। তুমি যাও তো বাবা, এখুনি গিয়ে টেলিফোন কর।
এখুনি টেলিফোন করতে হবে?
হ্যাঁ, এখুনি করতে হবে।
হোসেন সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, তুই বরং আরেকটু ভেবে-টেবে নে।
নীতু বিছানায় উঠে বসল। শান্ত গলায় বলল, আমার যা ভাবার আমি ভেবেছি–আর ভাবব না। তুমি যাও তো বাবা, টেলিফোন কর। হোসেন সাহেব বিরস মুখে উঠে দাঁড়ালেন। নীতু ড্রয়ার খুলে চিঠির কাগজ এবং কলম বের করল। তার গায়ে এখনো ভাল জ্বর। তাতে কিছু যায়-আসে না। জ্বর নিয়েও সে যা লেখার খুব গুছিয়ে লিখতে পারবে। হয়ত হাতের লেখা তত ভাল হবে না। ভাল না হলে না হবে। হাতের লেখা বড় কথা না, কি লেখা হচ্ছে সেটাই বড়…
আতাহার ভাই,
আপনি কেমন আছেন? চারদিন হল জ্বরে কষ্ট পাচ্ছি। এই চারদিনে একবারও মনে হল না–যাই মেয়েটাকে দেখে আসি। গতকাল বাসায় এসে ভাইয়ার সঙ্গে কিছুক্ষণ ফুসফাস করে চলে গেলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম। আপনি আমাকে দেখতে আসবেন। কাজেই খুব তাড়াহুড়া করে শাড়ি পারলাম। আমি দেখতে খারাপ তো–শাড়ি পরলে মাঝে-মধ্যে একটু ভাল দেখায়, তাই শাড়ি পরা–আপনি আসেননি। আমি পরে খোঁজ নিয়েছি, আমার জ্বর সম্পর্কে কিছু জানাতেও চাননি।
দরজায় পায়ের শব্দ হল। নীতু চিঠি লেখা বন্ধ করে তাকাল। আতাহার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আতাহার বলল, কয়েকদিনের জ্বরে তুই দেখি একেবারে শুটকি হয়ে গেছিস। শুটকির দোকানে তোকে ঝুলিয়ে রাখলে ছুড়ি মাছের শুটকি হিসেবে বিক্রি হয়ে যাবি।
নীতুর চোখ ভিজে উঠার উপক্রম হল। সে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল।
করছিস কি?
চিঠি লিখছি।
প্রেমপত্র?
হ্যাঁ, প্রেমপত্ৰ?
দুদিন পর তো বিয়েই হচ্ছে–এর মধ্যে প্রেমপত্র লেখার দরকার কি?
আপনি কেন শুধু শুধু আমাকে বিরক্ত করছেন?
তোকে বিরক্ত করছি?
হ্যাঁ, বিরক্ত করছেন। দয়া করে নিচে যান। চা-টা খেয়ে বিদেয় হোন।
অসুখে কাতর হয়ে আছিস, রোগী দেখে যাই–জ্বর আছে এখনো?
আতাহার ভাই, আপনি যান তো।
আচ্ছা রে ভাই যাচ্ছি। খ্যাক খ্যাক করিস না। প্রেমপত্ৰ–লিখে শেষ কর। মেজাজ আকাশে তুলে রাখলে সুন্দর সুন্দর শব্দ মনে আসবে না। শুধু মনে আসবে কঠিন কঠিন তৎসম শব্দ-উৎপ্রেক্ষা, শ্লাঘা, বাজনাদ, বৃকোদার–এই টাইপ শব্দ।