তুই কতক্ষণ থাকবি রে বটু?
বেশিক্ষণ থাকব না মা। রাত দশটার টেনে নেত্রকোনা যাচ্ছি। মজিদকে দেখতে যাচ্ছি।
কোন মজিদ?
পাগলা মজিদ–তোমাকে যে মাসি ডাকতো সেই মজিদ। মনে পড়েছে?
উহুঁ।
ঝাকড়া ঝাকড়া চুল। মোটাগাটা, থাপ থাপ করে হাঁটে। তোমাকে মাসি ডাকায় তুমি বললে–বাবা, তুমি আমাকে মাসি ডাকছ কেন? খালা ডাক। তখন সে বলল, আপনার হিন্দু হিন্দু চেহারা এই জন্যে আপনাকে মাসি ডাকছি। এখন মনে পড়েছে মা?
হুঁ, মনে পড়েছে।
অনেক দিন তাকে দেখি না–দেখতে ইচ্ছে করছে।
তুই এক যাচ্ছিস?
আমি এক যাব কি করে? আমার সঙ্গে কি টাকা পয়সা আছে? নেত্রকোেনা যেতে টেন ভাড়া লাগবে না? সাজ্জাদ। আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।
তোর হাতে টাকা পয়সা নেই?
কিছু নেই। কে এখন আমাকে টাকা দেবে? একশ টাকা পরিমল বাবুর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম–সেটা কবেই শেষ। উনি প্রতি দিন তিন-চারবার করে টাকাটা ফেরত চাইছেন। দিতে পারছি না।
তোর তো খুব খারাপ অবস্থা।
ভয়াবহ অবস্থা। তোমার অবস্থার চেয়েও একশ গুণ ভয়াবহ। তুমি তো ঘুমে ঘুমে সব পার করে দিচ্ছ, কিছু টের পোচ্ছ না। আমি তো আর ঘুমুচ্ছি না। জেগে আছি।
সমস্যার কথা শুনতে ভাল লাগছে না রে বটু ভাল কোন কথা বল।
ভাল কথা হচ্ছে–মিলি খুব সুখে আছে। ফরহাদ যে মিলির সঙ্গে গিয়েছিল আর ফিরে আসেনি। সে চিঠিতে জানিয়েছে–ঐখানে থেকেই সে পড়াশোনা করবে।
ভালই তো। বোনের সঙ্গে থাকবে।
হুঁ ভাল।
তোর কি হবে?
বুঝতে পারেছি না ম।
তোর কবিতা লেখার কি হচ্ছে?
অনেক দিন কিছু লিখতে পারছি না।
কেন?
জানি না মা।
তোর মুখটা এমন শুকনা লাগছে কেন? দুপুরে কিছু খেয়েছিস?
খেয়েছি।
মিথ্যা কথা বলছিস কেন বটু?
ও আচ্ছা, খাওয়া হয়নি।
পেটে খিদে নিয়ে আমার পাশে বসে আছিস?
এখন আর বসে থাকব না, উঠে যাব।
এত তাড়াতাড়ি উঠে যাবি কেন? তোর টেন তো রাত দশটায়। এখন বাজে মাত্র আটটা। কমলাপুর যেতে কতক্ষণ আর লাগবে?
অনেকক্ষণ লাগবে। রাস্তায় খুব ট্রাফিক জ্যাম। তাছাড়া যাবার আগে এখানকার একজন মহিলা ডাক্তারের সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করব। চা বা কফি খাওয়াবে।
বুঝেছি–বুড়ি। ও মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখে যায়। বড় ভাল মেয়ে।
হুঁ—একটু পাগলী ধরনের, তবে ভাল।
ওকে বিয়ে করবি?
কি আশ্চর্য, ওকে বিয়ে করব কেন?
তুই তো কিছুই করিস না, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াস–মেয়েটাকে বিয়ে করলে অন্তত খাওয়া-পরার দুঃশ্চিন্তা থেকে বাঁচবি। তোর কি মেয়েটাকে পছন্দ হয় না?
পছন্দ হয়। যাদের পছন্দ হয় তাদের বিয়ে করতে নেই মা।
এটা আবার কেমন কথা?
বিয়ে করলেই রহস্য থাকে না।
তোর যে কি সব পাগলামী কথা!
মা, যাই?
চলে যাবি?
হুঁ।
আশ্চর্য, যাবার আগে তুই আমাকে একবার ছুঁয়েও দেখবি না?
আতাহার মার কপালে হাত রাখল। কি অদ্ভূত অবস্থা!
ভালবাসা নিয়ে একজন স্পৰ্শ করছে। অন্যজন সেই স্পর্শ ফিরিয়ে দিতে পারছে না।
আতাহার ডাক্তার হোসনার ঘরের দিকে রওনা হল। তাকে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। হয়ত গিয়ে দেখা যাবে আজ তার নাইট ডিউটি নেই। ঘর তালাবন্ধ।
হোসনা টেবিল থেকে ড্রয়ার বের করে ড্রয়ারের জিনিসপত্র সারা টেবিলে ছড়িয়েছে। শিশি, বোতল, তুলা, কেঁচি, রাজ্যের জিনিস। আতাহারকে ঢুকতে দেখে বলল, কবি সাহেবের খবর কি?
আতাহার বলল, ভাল।
মার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
জ্বি।
কথা হয়েছে?
জ্বি, কথাও হয়েছে। আপনি কি খুঁজছেন?
টাং-ডিপ্রেসার–যা দিয়ে জিহবা চেপে ধরা যায়। জিহবা চেপে ধরলেই গলার ভেতরটা দেখা যায়।
খুঁজে পাচ্ছেন না?
পাব তো বটেই। সব কটা ড্রয়ার খুঁজতে হবে এবং মারফির সূত্র অনুসারে সবচে শেষের ভুয়ারে পাওয়া যাবে।
আজ তাহলে আমার চা খাওয়া হচ্ছে না।
না। আপনি বরং একটা কাজ করুন–কোন রেস্টুরেন্ট থেকে আমার একাউন্টে এক কাপ চা খেয়ে নিন।
আপনি টাকা দিচ্ছেন?
হ্যাঁ।
শুধু চা খাব নাকি? চায়ের সঙ্গে অন্য কিছুও খেতে পারি–চপ, সিঙ্গাড়া…?
হোসনা হেসে ফেলল। আতাহার লক্ষ্য করল, দারুণ ব্যস্ত ডাক্তার মেয়েও অন্যসব মেয়েদের মত সুন্দর করে হাসতে পারে।
কবি সাহেব!
জ্বি।
আপনাকে আজ ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত লাগছে কেন?
ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত লাগছে, কারণ দুপুরে কিছু খাইনি।
সে কি? খাননি কেন?
আতাহার হাসিমুখে বলল, মাঝে মাঝে উপোস দিতে ভাল লাগে। উপোস দিলে বোঝা যায় শরীর নামক একটা ব্যাপার। আমাদের আছে। সেই শরীরের দাবী উপেক্ষা করা কঠিন।
আপনি কি মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে পারবেন?
পারব।
তাহলে দয়া করে মিনিট দশেকের জন্যে বারান্দায় গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি টাং ডিপ্রেসারটা খুঁজে বের করে আসছি। আপনাকে আমার পরিচিত একটা হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াব।
এখানে অপেক্ষা করলে অসুবিধা আছে?
হ্যাঁ আছে। আমি কারো সামনে কিছু খুঁজতে পারি না।
আতাহার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। স্ট্রেচারে করে একজন রোগীকে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মনে ওটিতে নিচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই রোগীর মুখভর্তি হাসি। যেন সে আনন্দময় কোন কাজে রওনা হয়েছে। মানুষ তার সমগ্র জীবনে কত অসংখ্য বিস্ময়কর মুহুর্তের সম্মুখীনই না হয়। তাদের দেখা বিস্ময়কর মুহূর্তগুলো লিখে রাখত তাহলে চমৎকার হত—এবং একজনের সঙ্গে অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখতে পারত।
(একটু অংশ মিসিং আছে)
আতাহারকে চকচকে একশ টাকার একটা নোট দিতে পেরে তার খুব ভাল লাগছে। অন্য এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে। পিটুইটারী গ্ল্যান্ড থেকে বিশেষ কোন এনজাইম হয়ত রক্তে চলে এসেছে। রক্ত সেই এনজাইম দ্রুত নিয়ে গিয়েছে। মস্তিকে। মস্তিম্বক সিগনাল পেয়ে আনন্দিত হয়েছে।