তিনি তুলি হাতে নিলেন। নৃত্যরতা মেয়েটি মনে হল তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল। নূপুর ছাড়া নেচে সেও বোধহয় আরাম পাচ্ছে না। মোসাদ্দেক সাহেব নূপুর আঁকতে বসলেন।
সাজ্জাদের ঘরে অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোন বাজছে। সাজ্জাদ হাত বাড়ালেই টেলিফোন ধরতে পারে। তার ধরতে ইচ্ছা করছে না। টেলিফোনের শব্দে তার বিরক্তিও লাগছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে টেলিফোনটা খুব করুণ সুরে বাজছে। কান্নার একটা সুর আসছে। যন্ত্রটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে–প্লীজ, আমাকে হাতে নাও। আমার প্রতি দয়া কর, তুমি আমাকে হাতে নাও।
সাজ্জাদ টেলিফোন হাতে নিয়ে সত্যি সত্যি কান্না শুনল–ওপাশ থেকে ফুপিয়ে ফাঁপিয়ে কে যেন কাঁদছে।
সাজ্জাদ বলল, কে?
আপনার উপহার পেয়েছি। লজ্জা, দুঃখ এবং অপমানে কাঁদছি।
ছবিটা তো খুব সুন্দর।
সাজ্জাদ ভাই–আপনি একজন ভয়ংকর অসুস্থ মানুষ। ভয়ংকর অসুস্থ।
সুস্থ-অসুস্থ পুরো ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। আমার কাছে অন্যদের অসুস্থ মনে হয়।
সাজ্জাদ ভাই!
বল। কান্না থামাও, কান্না থামিয়ে বল। কান্নার জন্যে আমি তোমার কোন কথাই শুনতে পারছি না।
আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় কখন থেকে আপনি জানেন?
মনে নেই। অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমার মনে থাকে না।
আমার তখন তের বছর বয়স। মাত্র তের বছর।
আনলাকি থার্টিন?
আনলাকি তো বটেই, নয়ত আপনার সঙ্গে দেখা হবে কেন? সেদিন আপনার সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছিল মনে আছে?
না।
আমার মনে আছে। শুধু সেদিন না–এই পর্যন্ত আপনার সঙ্গে আমি যে কটা কথা বলেছি আমার সব মনে আছে। আমার প্রতিটি বাক্য দাড়ি-কমাসহ মুখস্থ আছে। আপনার স্মৃতিশক্তি আমার চেয়ে হাজারগুণে ভাল। কিছু কিছু মানুষের স্মৃতিশক্তি অপ্রয়োজনীয় তথ্য মনে রাখার জন্যে অসম্ভব ভাল। আমি সেই রকম একটা মেয়ে।
কান্না বন্ধ করে কথা বল লীলাবতী। আমি বেশির ভাগ কথাই বুঝতে পারছি না।
আপনার সব কথা না বুঝলেও হবে। আমার কথাগুলি বলা দরকার। আমি বলব তারপর টেলিফোন রেখে দেব।
আচ্ছ বেশ।
তের বছর বয়স থেকে আমার একটাই স্বপ্ন–আপনাকে পাশে পাওয়া। কত হাস্যকর ব্যাপার তার জন্যে করেছি। শুনবেন? কার কাছে যেন শুনলাম আজমীর শরীফে গিয়ে যা চাওয়া যায়। তাই পাওয়া যায়। আমি মাকে নিয়ে আজমীর শরীফ গেলাম। আপনি কি হাসছেন না?
না, হাসছি না। সিগারেট ধরিয়েছি। তারপর বল…
থাক, আর বলব না। শুনুন সাজ্জাদ ভাই, আপনি আমাকে কঠিন অপমান করেছেন। সেই অধিকার আপনার ছিল না। আপনি জানেন না–আমার জন্মদিনে এসে আমার খাটে ঠিক যে জায়গাটায় বসেছিলেন বাকি রাতটা আমি সেখানে বসেছিলাম–কারণ সেখানে আপনার গায়ের গন্ধ লেগে ছিল। আপনি কি হাসছেন। সাজ্জাদ ভাই?
না। সিগারেট-নিভে গিয়েছিল আবার ধরিয়েছি।
সাজ্জাদ ভাই!
বল।
আমি নাচ শিখেছিলাম। শুধু আপনার জন্যে?
জানতাম না তো?
এগারো বছর বয়সে আপনার সঙ্গে যখন প্রথম দেখা তখন আপনি আমাকে বললেন–তুমি যে ড্রেসটা পরে আছ সেটা কি নাচের ড্রেস? তুমি কি এই অনুষ্ঠানে নাচবে? আমি বললাম, না। আপনি বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি সুন্দর নাচতে পার।
ও, আচ্ছা।
সাজ্জাদ ভাই!
বল।
আপনি আর কোনদিন আমাদের বাসায় আসবেন না।
সেটা তো আগে একবার বলেছি।
আবার বললাম। আপনার দেয়ালে যে টেলিফোন নাম্পারটা লিখে রেখে এসেছি সেটা মুছে ফেলবেন।
আচ্ছা। তুমি কি পেইনটিংটা নষ্ট করে দিয়েছ? না। ছবিটা আমি সারাজীবন আমার শোবার ঘরে টানিয়ে রাখব। আমি ঠিক করেছি জীবনে আর কোনদিনই নাচব না। এক সময় নাচন্তাম সেই স্মৃতিটি ছবিতে থাকুক।
লীলাবতী, পেইনটিংটা কি সুন্দর হয়েছে?
লীলাবতী কাঁদতে কাঁদতে বলল, হ্যাঁ।
লীলাবতী, তোমাকে আমি ভালবাসি।
না।
না বলছ কেন? আমার মনের কথা তোমার জানার কথা না।
আপনি নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালবাসেন না। এবং অন্য কারো ভালবাসাও বুঝতে পারেন না। আপনাকে আল্লাহ অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু ভালবাসার এবং ভালবাসা বোকার ক্ষমতা দেন না।
হতে পারে।
টেলিফোন রেখে দিচ্ছি সাজ্জাদ ভাই।
আচ্ছা রেখে দাও। হ্যালো শোন, টেলিফোন রেখে দেবার আগে কি দু লাইন কবিতা শুনবে?
না।
মাত্ৰ দুটা লাইন। বেশী সময় লাগবে না।
আচ্ছা বলুন।
সাজ্জাদ হাসতে হাসতে বলল,
তুমি থাক জলে আর আমি থাকি স্থলে
আমাদের দেখা হবে মরণের কালে।
গভীর নিদ্রা
আতাহার তার মার পাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ডাকল, মা!
গভীর কমা থেকে ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন না। আতাহার নিজেই তার প্রশ্নের জবাব দিল–কিরে বটু?
কেমন আছ মা?
গভীর নিদ্রায় আছি। ভালই আছি। দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বোস।
বসার জায়গা দেখছি না। নল-টল লাগিয়ে তোমাকে যা করে রেখেছে–বসতে গিয়ে কোনটা খুলে পড়বে–কি বিপদ হবে কে জানে।
বিপদ আর কি হবে। দাঁড়িয়ে থাকিস না, বোস।
আতাহার সাবধানে মার পাশে বসল। ঘরে একজন নার্স ছিলেন, তিনি আতাহারের দিকে এক পলক তাকিয়ে বাইরে চলে গেলেন। এই ঘরে আলো বেশ কড়া। একটা আলো একেবারে চোখে এসে লাগছে। যে ঘরে রোগীরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন সেই ঘরের আলো অনেক নরম হওয়া উচিত। জিরো পাওয়ারের নীল বাতি জ্বলবে। খুব মৃদু সংগীত বাজবে। ঘুম পাড়ানো গান–
খোকা ঘুমুল
পাড়া জুড়ালো
বর্গি এল দেশে।
ঘরটা অন্যান্য ঘরের তুলনায় ঠাণ্ডা। এসির কারণেই ঠাণ্ডা। হিম-হিম ভাব। এটা ঠিক আছে। গভীর নিদ্রা এবং মৃত্যু দুইই শীতল। ঘর শীতল হবেই।