কাজের একটা মেয়ে দোতলা থেকে নেমে এসেছে। হোসেন সাহেব ফরিদা এসেছে। ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার দেখাদেখি আতাহারও উঠে দাঁড়াল। কাজের মেয়েটিকে দেখে হোসেন সাহেব খুব লজ্জা পেলেন। মেয়েটি বলল, কার কাছে আসছেন?
ফরিদার কাছে। ও আছে না?
জ্বি আছেন। আপনারা কি জন্যে এসেছেন? আপনাদের নাম?
তুমি গিয়ে বল নীতুর বাবা এসেছেন–হোসেন সাহেব। এই কার্ডটা নিয়ে দাও। কার্ড হাতে দিলেই বুঝবে।
কাজের মেয়েটা কার্ড হাতে নিয়ে চলে গেল। হোসেন সাহেব আনন্দ নিয়ে বসার ঘরের সাজসজ্জা দেখতে লাগলেন। তার কাছে মনে হচ্ছে ঘরের পর্দাগুলি একটু যেন ময়লা। ঝকঝকে ইস্ত্রি করা পর্দা ছাড়া এ বাড়ি মানায় না। ফরিদাকে পর্দার কথাটা বলবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। বললে মনে কষ্ট পেতে পারে। একটা আনন্দের দিনে মনে কষ্ট পাওয়া যায়, এমন কিছু বলা উচিত না।
কাজের মেয়েটি নেমে এল। আগের মতই গম্ভীর গলায় বলল, আম্মার শরীর ভাল না। শুয়ে আছে। নিচে আসতে পারবে না। বলেছে আপনাদের চা খেয়ে যেতে।
হোসেন সাহেব অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন মেয়েটার কথা তিনি বুঝতে পারছেন না। আতাহার বলল, আমরা চা খেয়ে এসেছি। চা খাব না। আপনি ফুল আর চকলেটগুলি উপরে নিয়ে যান।
বর্ষা শেষের রৌদ্রকরোজ্জল দিন। ড্রাইভার গাড়ি চালাছে। হোসেন সাহেব এবং আতাহার পেছনের সীটে বসে আছে। আতাহার বলল, চাচা, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
না।
বাকি কার্ডগুলি কি আজ বিলি করবেন?
না, আজ থাক।
চলুন কোন জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
কোথায় যাবে?
চিড়িয়াখানায় যাবেন চাচা? মাঝে মাঝে চিড়িয়াখানায় যেতে খুব ভাল লাগে।
চল যাই।
আতাহার গাড়ির ড্রাইভারকে মীরপুরের দিকে যেতে বলল। হোসেন সাহেব ডাকলেন, আতাহার!
জ্বি চাচা।
ফরিদার ব্যবহারে তুমি মনে কষ্ট পাওনি তো?
জ্বি না?
কষ্ট পেও না–বোধহয় কোন কারণে মন-টন খারাপ ছিল এই জন্যে দেখা করেনি। মানুষের মন বড় বিচিত্র আতাহার। মন একমাত্র জিনিস যার উপর মস্তিকের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
জ্বি চাচা।
আমরা ইচ্ছা করলে চোখের পাতা বন্ধ করি। হাত নাড়তে পারি, পা নাড়তে পারি কিন্তু ইচ্ছা করলেই হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ করতে পারি না। কেন পারি না জানি আতাহার?
জ্বি না, চাচা।
কারণ মন বাস করে হৃদপিণ্ডে। মনের উপর মস্তিক্ষেকের নিয়ন্ত্রণ নেই–এই কারণে।
আতাহার দীর্ঘশ্ববাস ফেলল। এই বৃদ্ধ মানুষটির প্রতি মমতায় তার চোখে পানি এসে যাবার মত হচ্ছে।
ভরা পূর্ণিমায় নৃত্যের ছবি
মোসাদ্দেক সাহেব পেইনটিংটা শেষ করেছেন। তিনি ক্লান্ত, কিন্তু তার চোখ ক্লান্ত না। তিনি প্রায় পলকহীন চোখে তাঁর শিল্পকর্মের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছবিটা এত সুন্দর হবে তিনি ভাবেননি। সাজ্জাদ যেমন বলেছিল। তিনি ছবিটা তেমন আঁকেননি। প্রহর শেষের রাঙা আলোয় নৃত্যের দৃশ্য নয়–তিনি এঁকেছেন ভরা পূর্ণিমায় নৃত্যের ছবি।
এতে একটা বড় লাভ হয়েছে–মেয়েটির শরীরে তিনি জোছনার কাপড় পরিয়ে দিতে পেরেছেন। মেয়েটি নগ্ন, তারপরেও তাকে নগ্ন মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে প্রকৃতির একটা অংশ। মোসাদ্দেক সাহেবের মনে হল, এই ছবিটি এক্সিবিশনে পাঠাতে পারলে অনেকেই অপূর্ব একটা শিল্পকর্ম দেখতে পারত। তিনি ছবির শিরোনাম দিতেন–
আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
ছবির মূল্য তালিকায় লিখে দিতেন—বিক্রয়ের জন্যে নয়। কিছু কিছু ছবির ভেতর আত্মা জেগে উঠে। আত্মা বিক্রি হয় না বলে সেই সব ছবির মূল্য ত লিখতে হয়–বিক্রয়ের জন্যে নয়।
আত্মা বিক্রয়ের জন্যে নয়–তাও কি ঠিক? আত্মাও বিক্রি হয়। কে যেন তার নিজের আত্মা শয়তানের কাছে বিক্রি করল। কি নাম তার–
ড: ফস্টাস?
নাকি মেসিস্টোফিলিস? সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
তিনি নিজেও কি তাঁর আত্মা বিক্রি করে দেননি? হ্যাঁ, বিক্রি করেছেন। খুব অল্প দামে বিক্রি করেছেন। মোসাদ্দেক সাহেব খাটের নিচ থেকে হুইস্কির বোতল বের করলেন। তিনি ক্ষুধার্তা। সকাল থেকে কিছু খাননি। এখন প্রায় তিনটার মত বাজে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় র হুইস্কি দ্রুত কাজ করবে। অতি অল্প সময়ে তিনি ঘোর এবং আচ্ছন্নতার একটা জগতে পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে তিনি তার আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকবেন। ছবিটা প্রাণভরে দেখে নিতে হবে। কারণ সাজ্জাদ সন্ধ্যার দিকে এসে ছবিটা নিয়ে যাবে। ছবির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আত্মার একটা অংশও চলে যাবে। তাকে আর কখনো পাওয়া যাবে না।
মোসাদ্দেক সাহেব এক চুমুকে অনেকখানি হুইস্কি খেয়ে ফেললেন। মাথার শিরা দপদপ করছে। হাতের আঙ্গুলগুলি মনে হচ্ছে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ধূক ধূক শব্দ হচ্ছে–কিসের শব্দ? হৃদপিণ্ডের শব্দ? নেশাগ্ৰস্ত অবস্থায় হৃদপিণ্ডের শব্দ এত স্পষ্ট হয়— আগে লক্ষ্য করেননি তো! তিনি আরো খানিকটা হুইস্পিক গলায় ঢাললেন। তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল–তার কাছে মনে হল ক্যানভাসে আঁকা মেয়েটা নাচছে। হেলো সিনেশন তো বটেই। প্রচুর মদ্যপান করলে এ রকম হয়–একটা মানুষকে দুটা দেখা যায়। এই ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। মন্দ না তো। মেয়েটা তো ভারি সুন্দর করে নাচছে। নূপুরের শব্দ হচ্ছে না কেন? নাচলে নূপুরের শব্দ তো হবার কথা। নূপুরের শব্দ না হবার কারণ তার কাছে স্পষ্ট হল। মেয়েটির পায়ে তিনি নূপুর আঁকেননি। নূপুর এঁকে দেয়া যাক। কতক্ষণ আর লাগবে। তাঁর হাত অবশ্যি কাঁপছে। তবে এই কম্পন তুলি হাতে নেয়ামাত্র থেমে যাবে।