আতাহার ঘর বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। ব্লইছুদিন এখনো আছে। সব কিছু দিকেই সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। আতাহারের দিকে তাকিয়ে তার ভুরু কুঁচকে গেল। আতাহার এগিয়ে গেল। এমন ভঙ্গিতে এগোল যেন অতি পরিচিত কোন বন্ধুর হাসিমুখ দেখৈ এগুচ্ছে।
ভাইসাহেব, আমাকে চিনছেন তো? সেভেন সি। ফ্ল্যাট দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। টানা একটা ঘুম দিলাম। এখন ফ্রেস লাগছে।
রইছুদ্দিনের ভুরু আগে থেকেই কুঁচকে ছিল, এখন আরো কুঁচকে গেল। আতাহার গলার স্বর নামিয়ে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল, তিনতলার ঐ মেয়েটার নাম কি? শ্যামলা মত, লম্বা, লালচে ধরনের চুল।
ইশরাত আপা।
ও আচ্ছা, ইশরাত আপা। উনাকে আমার ধন্যবাদ দিয়ে দেবেন। বলবেন খুব শিগগিরই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে।
রইছুদ্দিন তাকিয়ে আছে। আতাহার রওনা হয়েছে রাস্তার দিকে। কোথায় যাবে এ ব্যাপারে সে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
জাপানের ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর নেয়া দরকার। জাপান-বাংলা সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্যে সাংস্কৃতিক দল কবে যাত্রা করছে জানা দরকার। দলের নেতা ময়না ভাই অতিশয় ধুরন্ধর ব্যক্তি। তাঁর কাছে নিয়মিত হাজিরা দেয়া দরকার। নয়ত শেষ মুহুর্তে দেখা যাবে তবলাবাদক হিসেবে অন্য কেউ চলে গেছে।
ময়না ভাইকে রাত এগারেটার আগে কখনো পাওয়া যায় না। তার বেশ কয়েকটা আডিডার জায়গা আছে। তার কোনটাতে কখন থাকবেন তা কেউ বলতে পারে না। তাকে পেতে হলে সব কাঁটা আস্তানায় একবার করে ঢু মারতে হবে। সবচে কাছের আস্তানা হল–বিজয় নগরে সিনেমার অফিস পাড়া।
আতাহারের শরীর ঝিমঝিম করছে। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। ময়না ভাইয়ের সন্ধানে যাবার আগে কিছু খেয়ে নিতে হবে। নানরুটি-শিক কাবাব খাওয়া যায়। সস্তার দোকানোর নানরুটি এবং শিক কাবাব উপাদেয় হয় এবং অনেকক্ষণ পেটে থাকে–হজম হতে চায় না।
আতাহারের ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন। ময়না ভাইকে নিউ মুভিজের অফিস ঘরে পাওয়া গেল। টেবিলে পা তুলে চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। শুকনো মুখে অফিসের পিওন বসে আছে। তার মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। চোখ ঈষৎ লাল। ময়না ভাই সিগারেট খান না, কিন্তু আজ তার ঠোটে সিগারেট। সবই খুব ভাল লক্ষণ। ময়না ভাই মদের ঘোরে যখন থাকেন তখন খুব ভাল থাকেন। সবার সঙ্গে অতি মধুর ব্যবহার করেন। আতাহারকে দেখে ময়না ভাই ধমক দিয়ে উঠলেন, তোর ব্যাপারটা কি রে আতা? একেবারে দেখি ফ্লাওয়ার অব ড়ুমুর হয়ে গেছিস? তুই আমার পিছে ঘুরবি, না। আমি তোর পিছে পিছে ঘুরব?
ময়না ভাই মহা বিরক্ত হয়ে সিগারেটে টান দিলেন। আতাহার হাসল। তিনি বললেন, খবরদার, দাঁত কেলিয়ে হাসবি না।
জাপানের ব্যাপারটা কিছু হয়েছে ময়না ভাই?
অবশ্যই হয়েছে। হবে না মানে? আমার নাম ময়না। যা ধরি ছাড়ি না। আঠারো জনের দল যাবে। এর মধ্যে তোকে নিয়ে সাতজন হচ্ছে ফলস। তোরা টোকিওতে গিয়ে যার যার পথ ধরবি।
ভিসা কবে হবে?
পনেরো তারিখে ভিসার জন্যে কাগজপত্র জমা দিব। তোর পাসপোর্ট হয়েছে?
না।
এখনো পাসপোর্ট হয়নি। আর তুই দাঁত কেলিয়ে হাসছিস? তিনদিনের ভেতর পাসপোর্ট বের করে আমাকে দিয়ে যাবি।
আচ্ছা।
একেকজন আমার জান ফানা করে দিচ্ছে আর তোর কোন হুঁস নেই। গরাজটা কার? তোর না আমার?
আমার।
বোস। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আতাহার বসল। ময়না ভাই আক্ষেপের গলায় বললেন, লোকজন আমাকে বলে–মানুষ পাচারের যন্ত্র। অথচ কেউ বুঝে না। আমি করছি দেশের সেবা। বেকার যুবক পার করে দিচ্ছি, তার হার্ড ফরেন কারেন্সি পাচ্ছে। দেশের উন্নতি হচ্ছে। আমি যা করছি তার নাম দেশসেবা। ঠিক কি-না?
ঠিক তো বটেই।
এটা তো তুই হাসিমুখে বললি–ঠিক তো বটেই। আবার আড়ালে গিয়ে বলবি শালা ফটিকাবাজ। বললেও কিছু যায় আসে না। আমি নিজের মত কাজ করি। যার যা ইচ্ছা আমাকে বলুক। যার ইচ্ছা শালা বলুক। তুই কিছু খাবি, আয়। মুখ শুকনা লাগছে।
কিছু খাব না। ময়না ভাই।
তোর মত বেকার যুবকদের শুকনা মুখ যখন দেখি তখন মনটা খারাপ হয়। ধান্দাবাজ্বি করে তোদের বিদেশে নিয়ে যাই। অন্যায় যা করি হিউমেনিটারিয়ান গ্রাউন্ডে করি। যাই হোক, শোন, চার লাখ টাকার জোগাড় করা। পারহেড আমি সাত করে নিচ্ছি। তোর অবস্থা তো জানি। তোর জন্যে চার। বাকি তিন জাপান গিয়ে দিবি। ভাবিস না। টাকাটা আমার পকেটে যাচ্ছে–খরচপাতি আছে। টাকা যা নেই। সবটাই খরচ হয়ে যায়। কাল রাতে বাসায় ভাত খেয়েছি কি দিয়ে জানিস?
কি দিয়ে?
ডালের চচ্চড়ি আর টেংরা মাছের ঝোল। ঢাকা শহরের যে রিকশাওয়ালা তার বাড়িতেও এরচে ভাল রান্না হয়। যাই হোক, আমার কোন কমপ্লেইন নাই। রিজিকের মালিক আল্লাহপাক। আল্লাহপাক যদি আমার জন্যে টেংরা মাছের ব্যবস্থা করেন–আমার তো করার কিছু নেই। ঠিক না?
জ্বি, ঠিক তো বটেই।
এক সপ্তাহের মধ্যে টাকাটা জোগাড় করা। সবাই দিয়ে ফেলেছে, শুধু তুই বাকি।
চার লক্ষ টাকা আমি পাব কোথায় ময়না ভাই?
তুই কোথায় পাবি সেটা আমি কি জানি? বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নে। জাপানে গিয়ে মাসে দেড় লাখ থেকে দুলাখ টাকা চোখ বন্ধ করে কামাবি। সাত বছরের মাথায় কোটিপতি। শুরুর ইনভেস্টমেন্ট সেই তুলনায় কিছুই না। চার জোগাড় করতে পারবি না?
মনে হয় না।
গাধামি করিস না। এই সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না। চান্স অব লাইফ টাইম। তোকে স্নেহ করি বলেই সুযোগটা দিলাম–আচ্ছা যা, তিন লাখ ব্যবস্থা করা। তোর শুকনা মুখ দেখে মায়া লাগছে। বাকিটা জাপানে চাকরি করে শোধ দিস। দুই পারবি না?