আতাহার কয়েক মুহুর্ত ব্যয় করল মন স্থির করতে। সে কি করবে—আপার ফ্ল্যাটের দরজা খুলবে, না ছাদে গিয়ে মেয়েটিকে আরেকবার চমকে দেবে? ছাদে যাবার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাতিল করল। বেহুলার জন্যে এতটা ঝামেলা করা ঠিক হবে না।
তালা খুলে আতাহার ঘরে ঢুকেই প্রথম যে কাজটা করল তা হচ্ছে–গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেলল। ফাঁকা ফ্ল্যাট। এই ঘরে উদ্দোম হয়ে ঘুরে বেড়ালেও কারো কিছু বলার নেই।
ভাড়াতে কি কি ক্ষতি করেছে তার লিস্ট করতে হবে। তেমনি কোন ক্ষতি করেছে বলে মনে হচ্ছে না। প্লাস্টিক পেইন্টের দেয়ালে প্রচুর আঁকি-বুকি আছে। সে তো থাকবেই–বাচ্চ-কাচ্চা থাকবে। আর তারা দেয়ালে ছবি আঁকবে না তা হয় না। শিশুর কাছে দেয়াল হচ্ছে খাতার বড় একটা শাদা পাতা। সেখানে সে তো ছবি আঁকবেই।
দুটি বাথরুমের একটির কমোডের ঢাকনা ভাঙা। এমন কিছু ভয়াবহ ব্যাপার না। শোবার ঘরের জানালার কপাট খুলে এসেছে। ভাড়াটে টানাটানি করে খুলেছে এরকম মনে করার কোন কারণ নেই। আগেই নিশ্চয় খোলা ছিল।
রান্নাঘরের অবস্থা অবশ্যি শোচনীয়। রান্নাঘরের সবই ভাঙা। মনে হচ্ছে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙা হয়েছে। ভাড়াটের মনে হয় রান্নাঘরের উপরই রাগটা বেশি ছিল। পয়েন্ট বাই পয়েন্ট নোটবুকে লেখাও সম্ভব না। ফটোগ্রাফার ডাকিয়ে ছবি তুলে রাখা যেতে পারে। রান্নাঘরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই আতাহারের ক্লান্তি বোধ করল। চায়ের পিপাসা পেল।
দুটার মত বাজে। বাসায় ফিরে খেয়ে দেয়ে লম্বা ঘুম দিতে ইচ্ছা করছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির পূর্ণ বিবরণ না নিয়ে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। আজ ছুটির দিন–বাবা বারান্দায় অতি বিরক্ত ভঙ্গিতে ইজিচেয়ারে বসে আছেন। ছুটির দিন না হয়ে অন্যদিন হলে–এই সময়ে এসএসসি পরীক্ষাখীনিদের সেকেন্ড ব্যাচের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। রিটায়ার্ড হেড মাস্টার সাহেব তিন ব্যাচে ছাত্রীদের ইংরেজী শেখান। তিনটা থেকে পাঁচটা এক ব্যাচ, পাঁচটা থেকে সাতটা সেকেন্ড ব্যাচ, সাতটা থেকে নয়টা লাস্ট ব্যাচ। এক এক ব্যাচে পনেরোজন করে ছাত্রী। প্রত্যেককে দিতে হয় পাঁচশ করে। মাসে কুড়ি হাজার টাকার মত রোজগার। মন্দ কি?
আতাহার নোটবই বের করল। বল পয়েন্ট কালি ছাড়ছে না। নতুন কলম, আসার পথে কিনে আনা। নোটবইটাও নতুন। নীল রঙের প্লাস্টিকের মলাটে সুন্দর একটা খাতা। এরকম সুন্দর একটা খাতার শুরুটা হবে–ক্ষতির বিবরণ দিয়ে? প্রথম পৃষ্ঠায় একটা কবিতা থাকাটাই কি বাঞ্ছনীয় নয়? লিফট নিয়ে একটা কবিতা। লিফট হচ্ছে এমন একটা ঘর যা বড়ই অস্থির। ক্লান্তিহীনভাবে উঠা-নমা করছে। আতাহার শোবার ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেতে এলিয়ে পড়ল। বুকের নিচে বালিশ থাকলে উপুড় হয়ে লিখতে আরাম হত। নিজের টাকািপয়সা হলে সে বেশ কিছু কবিতা লেখার বালিশ নেবে। বিভিন্ন সাইজের বিভিন্ন মাপের বালিশ। ভেলভেটের কাভার। একেক বালিশের একেক রঙ–নেভীরু, স্বকাই বু, রেড, পার্পল, মেজেন্টা, ভায়োলেট। সে আবার উপুড় হয়ে বুকের নিচে বালিশ না দিয়ে কবিতা লিখতে পারে না। মজিদ তাকে ঠাট্টা করে ডাকে–উপুড় কবি। সে নিজে হচ্ছে চিৎ কবি। সে নাকি চিৎ হয়ে আকাশের দিকে না তাকিয়ে কবিতার লাইন গোছাতে পারে না।
আতাহার নেটবুকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখছে—
কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে তার সঙ্গে দেখা।
লোহার তৈরি ছোট্ট একটি ঘর।
বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোন যোগ নেই।
ঘরটা শুধু উঠছে আর নামছে।
নামছে আর উঠছে।
মানুষ ক্লান্ত হয়—
এ ঘরের কোন ক্লান্তি নেই।
এ রকম একটা ঘরেই বোধহয় বেহুলার বাসর হয়েছিল।
নিশ্চিছদ্ৰ লোহার একটা ঘর।
কোন সাপ সেখানে ঢুকতে পারবে না।
হিসহিস করে বলতে পারবে না, পাপ করো। পৃথিবীর সব আনন্দ পাপে।
পুণ্য আনন্দহীন। উল্লাসহীন।
পুণ্য করবেন আকাশের ফিরিশতারা।
কারণ পুণ্য করার জন্যেই তাদের তৈরি করা হয়েছে।
লোহার সেই ঘরে ঢোকার জন্যে সাপটা পথ খুঁজছিলো।
সেই ফাঁকে বেহুলা তাঁর স্বামীকে বললেন, কি হয়েছে, তুমি এত ঘামছ কেন?
আর তখন একটা সুতা সাপ ঢুকে গেল।
ফিসফিস করে কোন একটা পরামর্শ দিতে গেলো।
বেহুলা সেই পরামর্শ শুনলেন না বলেই কি লখিন্দরকে মরতে হল?
তার সঙ্গে আমার দেখা কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে।
ঘরটা শুধু ওঠে। আর নামে।
আমি তাকে বলতে গেলাম–আচ্ছা শুনুন, আপনার কি মনে হচ্ছে না
এই ঘরটা আসলে আমাদের বাসর ঘর?
আপনি আর কেউ নন, আপনি বেহুলা।
যেই আপনি ভালবেসে আমাকে কিছু বলতে যাবেন
ওম্নি একটা সুতা সাপ এসে আমাকে কামড়ে দেবে।
আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। দয়া করে কিছু বলবেন না।
কবিতা শেষ করেই আতাহারের ঘুম পেয়ে গেলো। সব সময় এরকম হয়। এমন ক্লান্তি লাগে। এ জন্যেই কবিতা লেখার জন্যে তার বালিশ দরকার। কবিতা শেষ হবে–বুকের নিচ থেকে বালিশ টেনে মাথার নিচে দিয়ে লম্বা ঘুম। আজ বালিশ নেই। শক্ত মেঝেতে মাথা রেখেই তাকে ঘুমাতে হবে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। ঠাণ্ডা মেঝে, ভাঙা জানোলা দিয়ে আরামদায়ক হাওয়া আসছে–আতাহার ঘুমিয়ে পড়ল। সে ঘুমুলো সন্ধ্যা পর্যন্ত।
ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর ক্ষীণ রেখা মেঝেতে এসে পড়েছে। পিন পিন করছে রাজ্যের মশা। আটতলায় মশা উঠতে পারে না, এই তথ্য তারা ভুল প্রমাণ করেছে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে তারা লিফট ব্যবহার করে আটতলায় উঠে এসে কবির রক্তপান করেছে।