ভদ্রলোক মুখে এমন ভঙ্গি করলেন যা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি রশীদ সাহেবের কথা বিশ্বাস করলেন না। কাজেই রশীদ সাহেবকে সিকিউরিটি সিস্টেম ব্যাখ্যা করতে হল। দীর্ঘ ব্যাখ্যার পর তিনি বললেন–বুঝলেন ভাই সাহেব, একটা মাছি যদি কোন ফ্লাটে যেতে চায় তাকেও আগে ইন্টারকমে অনুমতি নিতে হবে। এমন অবস্থা।
ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত নিতান্তই অনাগ্রহের সঙ্গে ফ্ল্যাট নিলেন এবং ভাড়া দেয়ার ব্যাপারেও অসীম অনাগ্রহ দেখাতে লাগলেন। চারমাস ভাড়া বাকি পড়ে গেল। তাগাদা দেয়ার দায়িত্ব পড়ল আতাহারের উপর। আতাহার তখন হাড়ে হাড়ে বুঝল সিকিউরিটি সিস্টেম কাকে বলে। সে আসে, ইন্টারকমে ভাড়াটে ভদ্রলোক বলে দেন–দেখা হবে না। দারোয়ানরা তখন আর তাকে উঠতে দেয় না। শুকনো মুখে বাড়িতে ফিরতে হয়। শুকনো মুখে, কারণ রশীদ সাহেবের নিয়ম হচ্ছে একজনের রাগ তাৎক্ষণিকভাবে অন্যজনের উপর ঢেলে দেয়া। ভাড়াটের রাগ পুরোটাই তার উপর আসবে এই ভেবেই মুখ শুকনো।
কি রে, ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল?
না।
না মানে কি? ফ্ল্যাটে ছিল না?
ছিল, দেখা করল না। দারোয়ন উঠতে দিল না।
তুই ফ্ল্যাটের মালিক, তোকে ফ্ল্যাটে উঠতে দিল না?
আমি তো ফ্ল্যাটের মালিক না। বড় আপা মালিক।
এইসব আইনের কথা তো দারোয়ান বুঝবে না।
বুঝিয়ে বললে বুঝবে না কেন? তুই হচ্ছিস একটা ছাগল, রামছাগল। এই জন্যেই কেউ তোকে পাত্তা দেয় না। মুখের মধ্যে সব সময় একটা চোর চোর ভাব। যা আমার সামনে থেকে। আর শোন, এখন থেকে দাড়ি কামাবি না। দাড়ি ছেড়ে দে। রামছাগলের মত। থুতনিতে কয়েকগাছা দাড়ি না হলে তোকে মানাবে না।
আতাহার পিতৃআজ্ঞা পালন করেছে। দাড়ি কামানো বন্ধ রেখেছে। থুতনিতে কয়েকগাছা দাড়ির বদলে সারামুখময় দাড়ি গজিয়ে গেছে। কাউকে কাউকে দাড়িতে মানায়। তাকে মানাচ্ছে না। দাড়ি রাখার পরেও মুখ থেকে চোর চোর ভাবটা যায় নি। বরং সামান্য বেড়েছে, সেই সঙ্গে অন্য কিছুও যুক্ত হয়েছে। সেই অন্য কিছু–শুভ না, অশুভ ধরনের। এপার্টমেন্টের ছোকরা যে কারণে গোড়া থেকেই তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। সে তাকে 7/C ফ্ল্যাটে যেতে দেবে না, বলাই বাহুল্য। বাবার আরো কিছু কঠিন কথা শুনতে হবে। রিটায়ার করার পর কোন মানুষই তার বেকার ছেলেপূলে সহ্য করতে পারে না। এটা দোষের কিছু না, এটাই স্বাভাবিক। আতাহার তাতে কিছু মনে করে না। তবে রশীদ সাহেব ইদানীং যে ব্যঙ্গ-বিদ্রািপ শুরু করেছেন তা সহ্য করা কঠিন। দীর্ঘদিন মেয়ে স্কুলে যেসব পুরুষ মাস্টারি করে তাদের স্বভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কি করে যেন ঢুকে যায়। তারা স্বাভাবিকভাবে কথাই বলতে পারে না।
আতাহার পাঞ্জাবির পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে বলল, এই যে দেখুন চাবি নিয়ে এসেছি, প্রমাণস্বরূপ যে ফ্ল্যাটটা আমাদের। তাছাড়া আমি আগেও অনেকবার এসেছি। আপনার সঙ্গেও আমার দেখা হয়েছে। তখন আমার দাড়ি ছিল না। মাস তিনেক হল দাড়ি রেখেছি। চেহারা বদলে গেছে বলে আপনি চিনতে পারছেন না। দয়া করে দাড়ি ছাড়া আমাকে কলপনা করুন। চিনতে পারবেন। এখন কি আমি যাব উপরে?
যান।
এপার্টমেন্ট হাউসের ছোকরা কঠিন চোখে তাকাচ্ছে। এর বোধহয় রসবোধ নেই। রসিকতা ধরার ক্ষমতা বিবর্জিত মানুষ। রসিক মানুষদের সঙ্গে রসিকতা করে কোন আরাম নেই। রসবোধহীন মানুষদের সঙ্গে রসিকতা করাতেই বেশি আনন্দ।
সব লিফটেই বাথরুমের মত আয়না থাকে। এই লিফটে নেই। সুন্দর ছিমছাম লোহার ঘর। কয়েকটি বাতি জ্বলছে, নিভছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। আতাহারের কাছে মনে হল এক্সস্ট ফ্যান, কারণ গায়ে বাতাস লাগছে না। এই ফ্যানের কাজ সম্ভবত লোহার ঘর থেকে দুষিত বাতাস বের করে দেয়া।
লিফট তিন তলায় থামল, দরজা খুলে গেল। লিফটের খোলা দরজার সামনে উনিশ-কুড়ি বছরের এক তরুণী। সে লিফটের ভেতর আতাহারকে দেখে ইতঃস্তত করছে–উঠবে কি উঠবে না। লোহার এই ঘরে দাড়িগোঁফ ওয়ালা এই যুবকের সঙ্গে ভ্ৰমণ করা কি ঠিক হবে? মেয়েটি শেষ পর্যন্ত উঠল। নিজেকে যথাসম্ভব এক কোণায় নিয়ে গেলো। হিংস্র জন্তুর সঙ্গে ভ্রমণের সময় এ জাতীয় সাবধানত মানুষ নিয়ে থাকে। আতাহারের ইচ্ছা করছে দাঁত-মুখ খিচিয়ে ঘ্যাও জাতীয় কোন শব্দ করে মেয়েটাকে ভয় দেখাতে। মজিদ থাকলে অবশ্যই এই কাজটা করত। কোন না কোন ভাবে ভয় দেখাতোই। আতাহার নিরীহ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। এক পলকের জন্যেও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। এতেও কাজ হবে। ভয় পাবে। মেয়েদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেও তারা ভয়ে অস্থির হয়। মেয়েটা তাকে অপমান করেছে। লিফটে তাকে দেখে প্রায় আঁৎকে ওঠার ভঙ্গি করেছে। ঢুকবে কি ঢুকবে না ভাব করেছে, কাজেই মেয়েটার শাস্তি প্রাপ্য। সাধারণ শাস্তি। পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকা। মেয়েটার নাম কি? নাম জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? নাম নিশ্চয়ই বলবে না। ধরা যাক তার নাম বেহুলা। লোহার ঘরে যেহেতু দেখা, সেহেতু বেহুলা নামটাই মানানসই। লিফট থেকে নেমে যাবার সময় সে কি বলবে–বেহুলা! আনন্দময় কিছু সময় তোমার সঙ্গে কাটলো। তোমাকে ধন্যবাদ?
লিফট থেকে নামার সময় আতাহার বেহুলার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বেহুলা তাতে যে ভাবে চমকালো সেও এক দর্শনীয় দৃশ্য। মেয়েটা যাচ্ছে কোথায়? ছাদে? তিন তলা থেকে উঠেছে। ছাদে যাচ্ছে। ভরদুপুরে ছাদে যাবে কেন?