ভাল।
ভাল হলে হাসপাতালে কেন?
হাসপাতালে যারা বাস করছে তাদের মধ্যে ভাল।
জাপান কবে যাচ্ছেন?
খুব শিগগির। তবে জাপানে যাই আর মালয়েশিয়াতে যাই–তোর পারাটার কথা মনে থাকবে।
আতাহার সিগারেট ধরালো। নীতু কঠিন গলায় বলল, সিগারেট ধরাবেন না আতাহার ভাই। কতবার আপনাকে বলেছি আমার সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না।
গন্ধ সহ্য করতে তোকে কে বলছে? আমি তো বসে বসে তোর মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়ব না। চলে যাব। এই সিগারেট হচ্ছে ফর দ্য রোড।
কফি তো খাননি। বানানো হচ্ছে।
তাহলে সিগারেট ফেলতে হবে। সিগারেট হাতে নিয়ে কফি খেতে দেব না।
সিগারেট ছাড়া কফি খাওয়ার মধ্যে কোন মজা আছে? দরকার নেই। আমার কফির। বিদায়। আর শোন নীতু, তুই একটু খাওয়া-দাওয়া কর। তুই যে হারে রোগা হচ্ছিস, কিছুদিন পর তোর আর ছায়া পড়বে না।
আতাহার উঠে দাঁড়াল। নীতুর ইচ্ছা হল বলে, ঠিক আছে। সিগারেট ফেলতে হবে না। কফি খেয়ে যান। বলতে গিয়েও নীতু বলল না। কথাগুলি গলার কাছে শক্ত বরফের দলার মত আটকে রইল। তাঁর আত্মসম্মান অতি তীব্র। সে মরে গেলেও নিজের কাছে ছোট হতে পারবে না। আতাহার ঠিক এগারো দিন পর তাদের বাড়িতে এসেছে। সে যে এইভাবে দিনক্ষণের হিসাব রাখে। তাও সে কোনদিন আতাহারকে জানাতে পারবে না। আজ যে আতাহার আসবে তাও সে জানত। ভোরে ঘুম ভেঙেই তার মনে হয়েছে আতাহার ভাই আসবে। কেন তার এরকম মনে হয়েছে তা সে জানে না। শুধু এইটুকু জানে, যখন তার মনে হয়। আতাহার ভাই আসবে, তখন সে আসে। একবার রাত এগারোটার সময় তার এ রকম মনে হল। সে অতি দ্রুত চুল বেঁধে, শাড়ি পরল। তারপর বসার ঘরে বসে রইল। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। আতাহার ভাই সত্যি সত্যি রাত সাড়ে এগারোটার সময় উপস্থিত।
এইসব কথা কাউকে বলা যাবে না। তার আগে সে বিষ খেয়ে মরে যাবে। বিষ খেয়ে মরা নীতুর কোন কথার কথা না। বিষ তার কাছে আছে। সত্যি আছে। তার বইপত্র যে বুক শেলফে আছে সেই শেলফের তিন নম্বর তাকে বই-এর পেছনে লুকানো আছে। নীতুর ধারণা, খুব বেশিদিন শিশিটা লুকিয়ে রাখতে হবে না।
আতাহার চলে যাবার পরপরই নীতু বাথরুমে ঢুকল। সে দিনের মধ্যে কয়েকবার শুধুমাত্র কাদার জন্যে বাথরুমে ঢুকে। তার অনেক গোপন দুঃখ-কষ্টের একটা হচ্ছে সে কালো। যতটুকু কালো হলে মারা মেয়েদের শ্যামলা বলেন–সে তার চেয়েও কালো। নীতুর ধারণা, যত দিন যাচ্ছে তার গায়ের রঙ ততই কালো হচ্ছে। কালো মেয়েদের আলাদা কিছু সৌন্দর্য থাকে। তাদের চোখ সুন্দর হয়, ঠোঁট সুন্দর হয়, হাসি সুন্দর হয়। তাই সবই অসুন্দর। নীতু আয়নার সামনে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না সামলাবার চেষ্টা করছে। পারছে না।
এক সময় বাড়ি-ঘরের সুন্দর সুন্দর নাম হত–সুরভি, কদম্ব, নীলাঞ্জন। এখন ইংরেজ্বি নামের চল হয়েছে। মনিকার এপার্টমেন্ট হাউসের নাম Elephant Park Apartments. বাংলা করলে কি হয়–হাতি-বাগান ঘরবাড়ি। এপার্টমেন্টের ভাল বাংলা কি ভাবতে ভাবতে আতাহার রিসিপশনের দিকে এগোলো। রিসিপশনে ছোকরা মতন একজন বসে। তার গায়ে শাদা ড্রেস, মনে হয় নেভীতে কাজ করে। বুক পকেটে নাম লেখা–রইছুদ্দিন।
রইছুদ্দিন বিশ্ৰীভাবে তাকাচ্ছে। আতাহার আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল। তাতে তেমন উপকার হল না। রইছুদ্দিন সন্দেহভাজন লোকদের দিকে যে দৃষ্টিতে তাকানোর নিয়ম সেই দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আতাহারের ধারণা, হলুদ দাগ পরা পাঞ্জাবির কারণে ব্যাপারটা ঘটছে। হলুদ দাগ ছাড়াও পাঞ্জাবিতে আরো কিছু ত্রুটি আছে। সাইজে খাটো। আজকাল লম্বা পাঞ্জাবির চল হয়েছে। পাঞ্জাবির ঝুল হাঁটু ছাড়িয়ে যত নামবে ততই উত্তম। মনে হয় হাতি-বাগান ঘরবাড়িতে হলুদ দাগ দেয়া খাটো পাঞ্জাবি পরে কেউ আসে না।
কাকে চান?
আতাহার লক্ষ্য করল কাকে চান প্রশ্নটা করা হয়েছে তার দিকে না তাকিয়ে। সন্দেহভাজন মানুষের দিকে লোকজন বিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঠিকই, কিন্তু কথা বলার সময় অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলে। আতাহার হাই তুলতে তুলতে বলল, কাউকে চাই না। আটতলায় আমাদের একটা এপার্টমেন্ট আছে 7/C, ভাড়া ছিল। ভাড়াটে বিদায় করা হয়েছে। আমি যাচ্ছি ইন্সপেকশনে। ভাড়াটে কি কি ক্ষতি করে গেছে তার লিস্ট করতে হবে। নোটবই এবং কলম নিয়ে এসেছি। নোটবই, কলম দেখতে চান?
রইছুদ্দিনের চোখে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হল। নোটবই এবং কলম দেখে সে তাকে আটতলায় যেতে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। এই এপার্টমেন্ট হাউসের সিকিউরিটি সিস্টেম খুব কঠিন। একটা মাছিও যদি কোন ফ্ল্যাটে যেতে চায় তাকেও ইন্টারকমে অনুমতি নিতে হবে। এটা আতাহারের কথা না–আতাহারের বাবা রশীদ সাহেবের কথা। তিনি এ জাতীয় কথা বলে ভজিয়ে-ভাজিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিলেন। যাকে ফ্ল্যাট দিয়েছিলেন সে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে ফ্ল্যাট নিল। কিছুই তার পছন্দ হয় না। নানান প্যাঁচালের কথা বলে।
লিফট নষ্ট হলে আটতলায় উঠব কিভাবে? আমার আবার হার্টের সমস্যা?
রশীদ সাহেব বললেন, লিফট, নষ্ট হবে কেন? জার্মান ওনাডা কোম্পানীর লিফট। পৃথিবীর সেরা। তাও একটা না, দুটা।
কারেন্ট যখন থাকবে না। তখন?
আটতলা বেশি উঁচু হয়ে যায়।
উঁচুই তো ভাল। যত উঁচুতে উঠবেন তত ফ্রেস বাতাস। মশা-মাছির উপদ্রব নেই। তাছাড়া সিকিউরিটি সিস্টেম দেখবেন না? এত কড়া সিকিউরিটি সিস্টেম বাংলাদেশের কোন এপার্টমেন্ট হাউসে নেই।