মানিব্যাগ পাওয়া গেল প্যান্টের পকেটে। এটা অত্যন্ত আশার কথা। মানিব্যাগের সন্ধানে আবার বাড়িতে ঢুকতে হলে সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবার সম্ভাবনা।
মানিব্যাগ খুলে আতাহার এক ঝলক দেখে নিল–লাল রঙ উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। তার মানে পঞ্চাশ টাকার নোট কোথাও লুকিয়ে আছে। বিরাট ভরসার কথা। আতাহার লম্বা লম্বা পা ফেলতে শুরু করল। সকালে নাশতা খাওয়া হয়নি। খিদে লাগছে। খিদের চেয়েও যা বড়–চায়ের পিপাসা হচ্ছে। দিনের প্রথম চা এখনো খাওয়া হয়নি। দিনের প্রথম চা পানের আনন্দ স্বগীয় আনন্দের কাছাকাছি।
চা—নাশতার জন্যে সবচে ভাল জায়গা হচ্ছে সাজ্জাদের কলাবাগানের বাসা। সাজ্জাদের ছোট বোন নীতু আতাহারকে দেখামাত্রই বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকাবে, তারপরেও চা-নাশতা এনে দেবে। এবং কঠিন গলায় বলবে, মানুষের বাসায় গিয়ে চেয়ে চেয়ে চানাশতা খেতে আপনার লজ্জা লাগে না? নীতু এবারই ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে। প্রথম ইউনিভার্সিটিতে ঢোকা মেয়েগুলি কঠিন কঠিন কথা বলে সবাইকে চমকে দিতে ভালবাসে, কাজেই নীতুর কোন কথাই ধর্তব্যের মধ্যে নয়। সমস্যা হচ্ছেন নীতুর বাবা হোসেন সাহেব। পৃথিবীর পাঁচজন বিরক্তিকর মানুষের তালিকা তৈরি হলে সেই তালিকাতেও তার নাম থাকার কথা। জগতের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে হোসেন সাহেব কিছু না কিছু জানেন। সেই জ্ঞান তিনি নিজের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। ছড়িয়ে দিতে চান। হাসি হাসি মুখে একঘেঁয়ে সুরে তিনি যখন জ্ঞান বিতরণ করেন তখন আতাহারের ইচ্ছা করে লোহার একটা শাবল দিয়ে ঠাস করে তাঁর মাথায় বাড়ি দেয়। সেটা সম্ভব হয় না বলে কৌতূহলী ভঙ্গি চোখে-মুখে ফুটিয়ে তাঁর যাবতীয় জ্ঞানের কথা শুনতে হয়। বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্য।
আশার কথা হচ্ছে আজ ছুটির দিন। ছুটির দিন হোসেন সাহেব সাপ্তাহিক বাজার করতে যান। আজ তার সঙ্গে দেখা না হবার সম্ভাবনাই বেশি।
চৈত্র মাস। এই সকালেই চিড়চিড়ে রোদ উঠে গেছে। বাতাস দিচ্ছে বলে রোদটা অগ্রাহ্য করে হীটতে ভাল লাগছে। দুপুরের মধ্যে অবস্থা অন্য রকম হবে। দালান-কোঠা থেকে ভাপ বেরুতে থাকবে। সেই ভাপে থাকবে দালান কোঠার প্রাচীন গন্ধ। রাস্তার পিচ নরম হয়ে স্যান্ডেলের সঙ্গে উঠে আসতে থাকবে। সারাক্ষণ নাকে লাগবে পিচের ঝাঝালো টক টাইপ গন্ধ। আতাহারের মত মানুষ, রাস্তায় হাঁটাই যাদের প্রধান কর্ম তাদের জন্যে, চৈত্র মাসের দুপুর বড়ই দুঃসময়।
আতাহার রিকশা নেবে, না হেঁটে হেঁটে যাবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মানিব্যাগের অবস্থা ভাল না। রিকশা ভাড়ার যন্ত্রণায় যাওয়া ঠিক হবে না। এখন বাজছে আটাটা। হেঁটে যেতে যেতে নটার মত বাজাবে। তাতে একটা সুবিধা হবে–হোসেন সাহেবের সঙ্গে দেখা হবে না। তিনি বাজারে চলে যাবেন। সাড়ে আটটার মধ্যে তিনি বাজারে যান। সাবধানতার জন্যে আরো আধঘণ্টা হাতে থাকা ভাল।
হোসেন সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তার গায়ে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি, হাতে ছড়ি। চোখে আঠারো ক্যারট সোনার চশমা। সোনালী ফ্রেমের ভেতর দিয়ে তার মায়া মায়া চোখ দেখা যাচ্ছে। তার সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে তিনি বউভাতের কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। আতাহারের বুক ধক করে উঠল। হোসেন সাহেব হাসিমুখে মধুর গলায় বললেন, কেমন আছ আতাহার?
জ্বি চাচা ভাল।
মুখ মলিন কেন?
হেঁটে এসেছি তো।
আপনি বাজারে যাননি?
হ্যাঁ যাব। তোমাকে পেয়ে ভালই হয়েছে, ঐ দিনের ডিসকাশনটা শেষ হয়নি। তুমি তাড়াহুড়া করে চলে গেলে, সূফীবাদের মূল ব্যাপারটা বলতে ভুলে গেলাম। আরাম করে বোস, আমি নীতুকে চা দিতে বলি।
আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে চাচা। আমার বড়বোন, যিনি আমেরিকায় থাকেন, তাঁর একটা ফ্ল্যাট আছে এলিফেন্ট রোডে। ঐ ফ্ল্যাটের ভাড়াটে তিন মাসের ভাড়া বাকি ফেলে চলে গেছে। যাবার আগে বাড়ির অনেক ক্ষতি করেছে। আমাকে এইসব দেখে বাবাকে রিপোট করতে হবে।
রিপোর্ট করে কি হবে? যা করতে হবে তা হল মামলা। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে কি করতে হয়? আঙুল বাঁকা করতে হয়। যত বাক্য করবে তত ঘি উঠবে।
জি, তা তো বটেই।
আমাদের সমস্যা কি জান আতাহার–আমরা আঙুল বাঁকা করতে পারি না। মুখে খুব হৈ-চৈ করি কিন্তু আঙুল বাকা করি না। ভাড়াটে ক্ষতি করে চলে গিয়েছে এই নিয়ে আমরা খুব চেঁচামেচি করব। একে বলব, তাকে বলব। কি কি ক্ষতি করেছে তার লিস্ট করব। তা করতে গিয়ে আমাদের দম ফুরিয়ে যাবে। আসল কাজ আর করা হবে না। ঠিক না?
জ্বি চাচা, ঠিক। আপনি খুবই খাটি কথা বলেছেন।
আসল কাজের প্রতি আমাদের অনীহার কারণ জান আতাহার?
আতাহার মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আজ দিনটা খারাপভাবে শুরু হয়েছে। একের পর এক প্যাঁচে জড়িয়ে যাচ্ছে। একটা প্যাঁচ খোলামাত্র অন্য একটা প্যাঁচ। এখন যে প্যাঁচে পড়েছে তার থেকে খুব সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে তা মনে হচ্ছে না। দোয়া ইউনুস পাঠ করা যেতে পারে। ইউনুস নবী মাছের পেটে নির্বাসিত হয়ে এই দোয়া পাঠ করেছিলেন। মাছ দোয়ার তেজ সহ্য করতে না পেরে তাকে উগরে ফেলে দিয়েছিল। আতাহারের ক্ষেত্রেও কি তা হবে? হোসেন সাহেব তাকে উগরে ফেলে দেবেন? আতাহার দোয়াটা মনে করতে পারছে না। বাস এবং বেবীট্যাক্সির ড্রাইভারদের চোখের সামনে এই দোয়া লেখা থাকে। আতাহার অসংখ্য বার পড়েছে। এখন আর মনে পড়ছে না। সে তাকিয়ে আছে হোসেন সাহেবের দিকে। হোসেন সাহেব হাসিমুখে কথা বলছেন,