গনি সাহেব শুকনো গলায় বলেলেন, লিখছিলাম না। পড়ছিলাম। লেখালেখির প্রথম ধাপ পড়াশোনা। তোমরা কেউ পড়াশোনার ধার দিয়ে যাও না, লেখালেখি শুরু করে দাও। এটা একটা আফসোস। ঐদিন এক ইয়ং ছেলে চারটা কবিতা নিয়ে এসেছে। আমি তাকে বললাম, অমিয় চক্রবতীর কবিতা পড়েছ? সে হা করে তাকিয়ে রইল। মনে হয় নামটা প্রথম শুনল। দেখে খুব মায়া লাগল। চা খাবে না-কি আতাহার?
জ্বি গনি ভাই, এক কাপ খেতে পারি।
গনি সাহেব চায়ের কথা বলে ফিরে এলেন। তাঁর চেহারা থেকে নিষ্পৃহ ভাব কিছুটা দূর হয়েছে। ঠোঁটের কোণায় হাসি হাসি ভাব। এটিও ভয়াবহ সংবাদ। সাহিত্য বিষয়ক দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়ার আগে গনি সাহেবের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা যায়।
আতাহার।
জ্বি গনি ভাই।
পড়। পড়। এক লক্ষ কবিতা পড়ার পর একটা কবিতা লিখবো। এবং সেই কবিতা ছাপানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়বে না। কবিতা লিখতে পারাটাই প্রধান, ছাপানো প্রধান না।
যদি কবিতা নাই ছাপি তাহলে লেখারই দরকার কি? কবিতা মাথায় থাকলেই হয়।
যথার্থ বলেছ। সেটাই হওয়া ভাল। পৃথিবীর প্রধান কবিরা তাদের শ্ৰেষ্ঠ কবিতা কোনটাই লিখেননি। মাথার মধ্যে রেখে দিয়েছেন।
আতাহার মনে মনে বলল, চুপ থাক গাধর বাচ্চা। অফ যা।
শোন আতাহার। দাড়ি রেখে পাঞ্জাবি পরে ঘুরঘুর করলেই কবি হওয়া যায় না।
আতাহার আবার মনে মনে বলল, গাধার বাচ্চা গাধা হয়, তুই হয়েছিস খাটাস।
চা চলে এসেছে। অতিরিক্ত চিনি দেয়ার পরেও সেই চায়ের তিতকুটে ভাব যায়নি। চায়ের প্রধান যে গুণ উত্তাপ তাও তার নেই। এই চা গনি সাহেবের মতই ঠাণ্ডা।
আতাহার?
জ্বি গনিভাই।
ছন্দ বিষয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান ছাড়াই তোমরা কবিতা লিখতে যাও। এত হাস্যকর আমার কাছে লাগে! এ দেশের খুব নামী দামী একজন কবি কয়েকদিন আগে আমার কাছে দুটা কবিতা পাঠিয়েছেন। আমি তার নাম বলব না। নাম বলাটা ঠিক হবে না। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা–পদে পদে ছন্দ ভূল। যেখানে তিন মাত্ৰা হওয়ার কথা সেখানে দুমাত্রা। ক্লান্তি শব্দটা ট্রিট করেছে তিন মাত্রা হিসাবে। রীতিমত স্কুল করে এদের ছন্দ শেখানো উচিত। কাজটা কে করবে?
আপনি ছন্দের উপর একটা বই লিখুন গনি ভাই। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশি দুই বাংলায় কেউ জানে না।
গনি সাহেব আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে অতিরিক্ত গভীর হয়ে গেলেন। আতাহার মনে মনে হাসল। খাটাসটা ফ্লাটারি ধরতে পারে না। আতাহারের কথা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। খাটাসটার দোষ নেই–বুদ্ধিমানরাই ফ্রােটারি ধরতে পারে না, আর এ হচ্ছে গাধার বাচ্চা খাটাস।
আতাহার।
জ্বি।
ছন্দের উপর একটা বই লেখার ইচ্ছা আমার আছে। লিখব কাদের জন্যে? পণ্ডশ্ৰম।
পণ্ডশ্রম হলেও আপনাকেই লিখতে হবে। আমরা আপনার ছন্দজ্ঞান নিয়ে প্রায়ই কথা বলি। আপনাকে আমরা আড়ালে কি ডাকি জানেন গনি ভাই? আড়ালে ডাকি–চালুনি।
আপনাকে আমরা বলি ছন্দের চালুনি। যত বড় কবিই হোক চালুনির মধ্যে আটকা পড়ে যাবে।
গনি সাহেব অত্যন্ত প্রীত হলেন। আনন্দ তাঁর চোখ-মুখে ফুটে উঠল। উদার গলায় বললেন–তুমি ইদানীং কিছু লিখেছ না-কি?
একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম।
নাম কি?
বাসর।
বাসর নামে মডার্ন একজন কবি কবিতা লিখবে ভাবাই যায় না, বাসর-ফাসর হচ্ছে মিডল ক্লাস ফ্যান্টাসি।
একটু যদি পড়ে দেখেন গনি ভাই। আপনি কবিতাটা পড়েছেন এটাই আমার জন্যে বিরাট ঘটনা।
গনি সাহেব চোখ-মুখ কুঁচকে কবিতা পড়তে শুরু করলেন–এক হাতে তাল দিয়ে ছন্দ দেখছেন। ছন্দের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয়। মাঝে মধ্যে গনি সাহেবের মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছেন।
কেমন হয়েছে। গনি ভাই?
আছে–থোর বড়ি খাড়া। খাড়া বড়ি থোর।
আতাহার মনে মনে বলল–থোর বড়ি তোর পশ্চাদেশ দিয়ে ঢুকিয়ে দেব শালা চালবাজ।
গনি ভাই।
হুঁ।
ঠিকঠাক করে যদি আপনার পত্রিকায়।
আচ্ছা, দেখি।
আপনার হাত দিয়ে একটা কবিতা ছাপা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।
দেখি দেখি–অনেক কাটাকুটি লাগবে।
আমি তাহলে উঠি গনি ভাই।
উঠবে! আচ্ছা যাও— ও ভাল কথা, এন্টাসিডের একটা বোতল এনে দাও তো–গ্রাক্সো কোম্পানীর। দাঁড়াও টাকা এনে দি।
টাকা লাগবে না। গনি ভাই আছে আমার কাছে, পরে দিয়ে দেবেন।
আবদুল গনি অত্যন্ত উদার ভঙ্গিতে বললেন, দেখি সামনের সংখ্যায় দিয়ে দেব। তবে লিসন টু মাই অনেস্ট এডভাইজ। এইসব আজেবাজে লেখা ছেড়ে ভাল কিছু লেখার চেষ্টা করো। গ্রো আপ। গ্রো আপ।
আতাহার মনে মনে বলল, হে খাটাস, তোকে আমি পুঁতে ফেলব। পাঁচ হাত গভীর একটা গর্ত করে তার ভেতর পুঁতব। গোবর সার দেব, পানি দেব, যাতে একটা গাছ হিসেবে তুই আবার পৃথিবীতে আসতে পারিস। সেই গাছে কোন ফল হবে না, ফুল ফুটবে না। সেই গাছে শুধু আঁটি জন্মাবে। শক্ত শক্ত আঁটি।
কিছু ভাবছো না-কি আতাহার?
জ্বি না।
গ্ল্যাক্সো কোম্পানীর এন্টাসিড কিনে গনি সাহেবের হাতে দিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনা ঘটল। ম্যানহোলে পা বেজে গিয়ে চামড়া ছিলে গেল। ম্যানহোলের বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধানতার জন্যই ঘটনাটা ঘটেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটলে এই সমস্যা হত না। আতাহার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঘন কালো। মেঘ। আর মেঘা জমছে। মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার হয়ে এল। সুন্দর যে সব কথা সবই বলা হয়ে গেছে। সবচে বেশি বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের জন্ম বাংলা সাহিত্যের বড় দূর্ঘটনার একটি। তাঁর কারণে সুন্দরের চিন্তা ও ব্যাখ্যায় অন্যেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এই ব্যাপারটা কি কেউ লক্ষ্য করেছে?