সেবার আজরাইলকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। আল্লাহ পাক সালমা বানু নামের অতি নগণ্য এক মহিলার কথা শুনেছিলেন।
ও বটু।
কি মা?
এত দূরে বসে আছিস কেন, কাছে এসে বোস না।
রোগীর গা ঘেঁসে বসে থাকতে আমার জঘন্য লাগে মা।
থাক, তাহলে দূরেই বসে থাক। বাসার খবর কি?
বাসার খবর ভয়াবহ।
ভয়াবহ মানে কি?
বাবা স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চালু করেছেন। তুমি না থাকায় সংসারের এসেম্ৱীতে বিরোধীদল অনুপস্থিত। বাবার যা ইচ্ছা করে যাচ্ছেন।
কি করছে?
কোত্থেকে কাল দুটা বেল নিয়ে এসেছেন। কাঁচা বেল। সেই কাঁচা বেলই হাত দিয়ে কচলে পানি মিশিয়ে বাকিয়ে বেলের সরবত বানিয়ে ফেললেন। সেই বিষ সবাইকে এক গ্লাস খেতে হবে।
সালমা বানু হাসছেন। ছেলে এত সুন্দর করে কথা বলে যে, শুধু শুনতেই ইচ্ছা! করে। তার ধারণা, এই ছেলের সঙ্গে যে মেয়ের বিয়ে হবে সেই মেয়ে মহা ভাগ্যবতী। মুগ্ধ হয়ে সে শুধু স্বামীর কথা শুনবে। তাছাড়া এমন রূপবান একজন পুরুষ পাওয়াও তো ভাগ্যের ব্যাপার।
ও বটু!
বটুবটুকরবে না তো। বঁটু ডাকলে নিজেকে কুলী সর্দার কুলী সর্দার বলে মনে হয়।
এত বড় নাম মুখে নিতে পারি না। ছোট একটা কিছু ডাকতে ইচ্ছা করে।
কবি ডাকলেই পার। ছোট দুই অক্ষরের ইকারান্ত নাম। মাত্র দুই মাত্রা।
তোকে যে কবি ডাকব, তুই কবি না-কি?
অবশ্যই কবি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শুধু জীবনানন্দ ছাড়া আমার চেয়ে ক্ষমতাবান কোন কবি জন্মায়নি।
দাড়িতে তোকে অবশ্যি খানিকটা রবীন্দ্রনাথের মত লাগছে।
সত্যি?
হুঁ, সত্যি।
তোকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সুন্দর লাগছে। উনার গায়ের রঙ ছিল কালো–তোর গায়ের রঙ দুধে-আলতায়।
রবীন্দ্রনাথের গায়ের রঙ কালো ছিল কে বলেছে?
কোন বইতে যেন পড়েছিলাম। তুই উনার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।
পৃথিবীর সব মা নিজের ছেলেমেয়ে সম্পর্কে এরকম ভাবে। যে ছেলের এক ঠ্যাং নেই সেই ছেলের মা নিজের ছেলে সম্পর্কে ভাবে–লাঠিতে ভর দিয়ে আমার ছেলের মত সুন্দর করে কেউ হাঁটতে পারে না।
সালমা বানু হাসছেন। প্রথমে নিঃশব্দে, তারপর শব্দ করে। আতাহার বলল, মা যাই।
যাই যাই করছিস কেন? আরেকটু বোস।
রোগীর কাছে বেশিক্ষণ বসা ঠিক না। তুমি দ্রুত শরীর সারিয়ে বাসায় ফিরে আস।
সালমা বানু বললেন, টেবিলের উপর থেকে কালো ব্যাগটা দে তো। আতাহার ব্যাগ দিল। তিনি ব্যাগ খুলে একশ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, নে!
আতাহার অবাক হয়ে বলল, কি?
কি আবার, টাকা।
টাকা কি জন্যে?
খরচ করবি। চা-টা খাবি।
তোমাকে দেখতে আসার ঘুষ না-কি মা? তাহলে তো রোজ রোজ আসতে হয়।
আতাহার অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে টাকা নিল। আজ টাকাটা খুব কাজে আসবে। আতাহার যাবে সাপ্তাহিক সুবর্ণের সম্পাদক আবদুল গনির কাছে। বাসর কবিতাটার কোন গতি করা যায় কি-না তা দেখবে। আবদুল গনি সাহেবের কাছে খালি হাতে যাওয়া যায় না। সব সময়ই কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হয়। সাহিত্য বিষয়ে তার দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর বক্তৃতা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শুনতে হয়। কোন রকম সাহিত্যবোধহীন একজন মানুষ এত সুন্দর একটা সাহিত্য পত্রিকা কি করে বের করছে কে জানে! জগতের অসংখ্য রহস্যের মত এও এক রহস্য।
আতাহার হাসপাতাল থেকে বের হল বেলা এগারোটায়। ভোরবেলা যখন বের হয়েছিল তখন চনমনে রোদ ছিল। আকাশ এখন মেঘে মেঘে ঢাকা। এত মেঘ হঠাৎ কোখোকে উদয় হল কে জানে! ভুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলে খুব যন্ত্রণা হবে।
আজ বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না। পকেটে কবিতা। কবিতা ভিজে যাবে। কোন একটা দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করা ভয়াবহ শাস্তির মধ্যে একটি। বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করলে বৃষ্টি বাড়তে থাকে–এটি জগতের আদি সত্যের একটি।
আবদুল গনি সাহেব থাকেন পুরানো ঢাকায়। আগামসি লেনে। কয়েক ফোটা বৃষ্টি পড়লেই তার বাড়ির সামনের গলিতে এক কোমর পানি জমে যায়। সেই পানি আলকাতরার মত ঘন কালো। পানির ঘনত্বও বেশি, কারণ সব কিছুই সেই পানিতে ভাসে–মরা কুকুর, মরা বিড়াল, মরা মুরগি। গলিতে ঢাকনাবিহীন দুটা ম্যানহোল আছে। আতাহারের বন্ধু সাজ্জাদের ধারণা, ম্যানহোল দুটির মধ্যে একটি জীবন্ত। সে জায়গা বদলায়। কখনো সে থাকে গলির মাঝামাঝি, কখনো সাইডে চলে আসে। বৃষ্টি-বাদলার দিনে যতবার সাজ্জাদকে নিয়ে আতাহার প্রাজ্ঞ সমালোচকের বাসায় গিয়েছে ততবারই সাজ্জাদ। ম্যানহোলে পড়ে গেছে।
বৃষ্টির আগে আগেই আতাহার আবদুল গনি সাহেবের বাসায় পৌঁছে কড়া নাড়ল। গনি সাহেব বের হয়ে এলেন। ছোটখাট মানুষ। শান্ত সৌম্য চেহারা। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চমশা। গায়ে পাতলা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জি নেই বলে রোমশ বুক দেখা যাচ্ছে। গনি সাহেব অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, ও, তুমি আতাহার। খবর কি?
আতাহার বলল, গনি ভাই, কেমন আছেন?
বলেই গাল ভর্তি করে হাসল। তার হাসি থেকে মনে হতে পারে যে মহাপুরুষের দর্শন পেয়ে সে কৃতাৰ্থ। তাঁর আনন্দ রাখার জায়গা নেই।
আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট এনেছি, গনি ভাই।
আতাহার সিগারেটের প্যাকেট বের করল। বেনসন এন্ড হেজে জ। এমিতে যাট টাকায় পাওয়া যায়, আজ আশি টাকা লাগল। সিগারেটের প্যাকেট দেখেও গনি সাহেবের মুখের নিষ্পৃহ ভাব কাটল না। তবে তিনি বললেন, বোস।
আতাহার বলল, আপনার সময় নষ্ট করব না। গনি ভাই। এক্ষুণি বিদায় হব। লিখছিলেন নিশ্চয়ই।