ভাইয়া, তুমি অসাধারণ।
এরকম কাঁদতে কাঁদতে কথা বলছিস কেন? চোখ মুছে স্বাভাবিকভাবে কথা বল। চোখের পানিতে তোর টাই ভিজে গেছে। টাইয়ের রঙ কাচা হলে রঙ ওঠে যাবে। সবাই তোকে দেখছে। প্লেন লেট আছে। চা খাবি? আয় চা খাই।
চল।
দু ভাই চা খেতে দুকল। আতাহার মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিল যে মিলি ঠাকুরগাঁ থেকে আসতে পারে নি। মিলির শাশুড়ি অসুস্থ, মরনাপন্ন। মিলি বিদায়ের সময় উপস্থিত থাকলে এক হাঁটু চোখের পানিতে এয়ারপোর্ট ড়ুবে যেত।
আতাহার বলল, ফরহাদ তুই এরকম অদ্ভূত ভঙ্গিতে হাঁটছিস কেন?
জুতাগুলি খুব টাইট হয়েছে।
টাইট হলে জুতা ফেলে দে। আমার স্যান্ডেল পরে চলে যা।
সত্যি স্যান্ডেল পরে যাব?
হ্যাঁ যা।
সবাই তাকিয়ে থাকবে। সুট পরেছি, পায়ে স্যান্ডেল।
তাহলে থাক।
রেস্টুরেন্টে ফরহাদ সারাক্ষণই একহাতে তার ভাইয়ের হাত ধরে থাকল। সেই হাত ছাড়ল শুধু ইমিগ্রেশন এরিয়ায় ঢোকার আগে।
আতাহার বলল, দাঁড়িয়ে থাকিস না–ঢুকে যা।
আমার প্লেন না ছাড়া পর্যন্ত ভাইয়া তুমি কিন্তু এয়ারপোর্ট ছেড়ে যাবে না।
না, যাব না। তুই রুমাল দিয়ে চোখটা ভালমত মোছ।
ফরহাদ রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। তাতে চোখের পানির কেন উনিশ বিশ হল না। টপ টপ করে চোখের পানি পড়ছেই।
আতাহার বৃটিশ এয়ার ওয়াজের বিমান আকাশে না উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। বিমান আকাশে মিলিয়ে যাবার পর মনে হল–বাসায় ফিরেই বা কি হবে। একটা রাত এয়ারপেট কাটিয়ে দেয়া যায় না? অবশ্যই যায়। এয়ারপোর্টে চায়ের দোকান আছে। সে দোকান নিশ্চয়ই সারারাত খোলা থাকে। দোকানের সামনে কোন একটা চেয়ারে বসে মানুষের মনের একটা জটিল রহস্য নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। রহস্যটা হচ্ছে–ফরহাদ চলে যাওয়ায় তার এত খারাপ লাগছে কেন? তার মা মারা গেছে, বাবা মারা গেছে–কিন্তু সে এতটা কষ্টতো পায়নি। তার ভাই, যার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না বললেই হয়–তার জন্যে এতটা খারাপ লাগার মানে কি? এত জটিল কেন মানুষের মন?
এয়ারপোর্টে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। হেঁটে হেঁটে ঢাকার দিকে রওনা হলে কেমন হয়? একসময় না একসময় ঢাকায় নিশ্চয় পৌছে যাবে। আর পৌঁছতে না পারলেও ক্ষতি নেই–মানুষের যাত্রা কখনো শেষ হয় না। সে চলতেই থাকে। চলতেই থাকে। মৃত্যুর পরেও সে যাত্রা শেষ হয় না–তখন শুরু হয় অন্য এক মাত্রা।
হাঁটতে শুরু করে আতাহারের মনে হল সে আসলে ঢাকায় যেতে চাচ্ছে না। মন টানছে না। অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে। সেই অন্য কোথাওটা আসলে কোথায় তা তার জানা নেই।
গণি সাহেব আতাহারকে দেখে আঁৎকে উঠলেন। অবাক হয়ে বললেন, কি হয়েছে তোমার?
আতাহার বলল, কিছু হয়নিতো।
তোমাকে লাগছে। মরা মানুষের মত। ইজ এনিথিং রং?
জ্বি না।
আসছ কোত্থেকে?
এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছিতো মনে এজন্যই ক্লান্ত লাগছে।
এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে আসার দরকার কি? অর্থহীন পাগলামী তোমরা কেন করা? ক্রিয়েটিভিটি এবং পাগলামীকে তোমরা সমার্থক করে ফেলেছি। এটা ঠিক না। আতাহার। ক্রিয়েটিভিটি এবং পাগলামী দুটা দুজিনিস। এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে কেন এলে এটা আমাকে বুঝিয়ে বল দেখি?
আতাহার কিছু বলল না। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আবার উঠে চলে যেতেও ইচ্ছা করছে না।
আতাহার!
জ্বি।
তোমার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে। শীত সংখ্যায় তোমার চারটা কবিতা এক সঙ্গে যাচ্ছে। শীত সংখ্যা বের হলে তোমাকে চমকে দেব বলে আগে খবর দেইনি। এখন তোমার অবস্থা দেখে আগে ভাগেই বললাম। কবিতাগুলি ভাল হয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। দু এক জায়গায় ছন্দ ভুল আছে। মাত্রা এদিক ওদিক করলে ঠিক হয়ে যায়–তবে আমি হাত দেইনি।
হাত দেননি কেন?
একদিন যদি খুব বিখ্যাত কেউ হয়ে যাও তখন তোমার কবিতায় হাত দেয়ার জন্যে দেশের লোক আমার উপর রাগ করবে। এই ভয়েই হাত দেইনি।
আতাহারের মন গভীর আনন্দে আচ্ছন্ন হবার কথা। তা হচ্ছে না। বড় ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে এই চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভাল লাগত। মাথার দু পাশের শিরা দীপ দাপ করছে। জ্বর হবার আগে কি এ রকম হয়? অনেক দিন তার অসুখ বিসুখ হয় না। অসুখের আগের শারীরিক ব্যাপারগুলি সে জানে না।
আতাহার!
জ্বি।
বাসায় চলে যাও। টেক রেস্ট। ইয়াং ম্যান, শরীরের দিকে লক্ষ্য রেখো। রবীন্দ্রনাথ শরীর ঠিক রাখার জন্যে আশি বছর বয়সেও চিরতার পানি খেতেন। হালকা ব্যায়াম করতেন। রিমেম্বাবরি দ্যটি। টাকা লাগবে? নাও, পঞ্চাশটা টাকা রেখে দাও।
আতাহার হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল। তার কোন অস্বস্থি বা লজ্জাবোধ হল না। গণি সাহেব বললেন–কোন দিন যদি অতি বিখ্যাত হও তাহলে এই সব খুটি নাটি মনে রাখবে। জীবনী লেখার সময় অবশ্যই আমার কথা লিখবো। লিখবো–প্রথম জীবন বড় অর্থ কষ্টে কেটেছে। সে সময় সুবর্ণ সম্পাদক জনাব আব্দুল গণি আমাকে বিভিন্ন সময়ে অর্থ সাহায্য করেছেন। হা হা হা।
আতাহার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল–আপনি নিজে কি জানেন, মানুষ হিসেবে আপনি প্রথম শ্রেণীর।
গণি সাহেব বললেন, না জানি না। তোমার কাছে প্রথম শুনলাম। মানুষ হিসেবে আমি প্রথম শ্রেণীর না। তোমার কাছে মনে হচ্ছে, কারণ তোমাকে উপরে ওঠার জন্যে আমি সাহায্য করেছি। সিঁড়ি কেটে দিচ্ছি। সিঁড়ি সবার জন্যেই কাটা হয়। সবাই সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে না। তোমার বন্ধু মজিদ পারল না। লাফিয়ে কয়েক ধাপ উঠেই হুমকি খেয়ে পড়ে গেল। সাজ্জাদও পারল না। শুনেছি ও কোন এক চিকিৎসা কেন্দ্ৰে আছে। কথাটা কি সত্যি?