না।
তাহলে কি জন্য মন খারাপ লাগছে?
হোসেন সাহেব চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আমার জন্যে তোদের সবার জীবন উলট পালট হয়ে গেল এই জন্য মন খারাপ লাগছে।
তোমার জন্যে হবে কেন?
অবশ্যই আমার জন্যে। আমি তোদের ঠিকমত মানুষ করতে পারি নি। ঠিকমত মানুষ করলে এই সমস্যা হত না। তোদের দুজনের জীবনই ধ্বংস করে দিয়েছি। সব সময় আমার নিজেকেই দোষী মনে হয়।
নীতু বলল, শুধু শুধু কষ্ট পেও না বাবা! তুমি কারো জীবন নষ্ট করনি। আরেকটা কথা বাবা তুমি বার বার দুজনের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। এসব বলছ কেন? ভাইয়ার জীবন খানিকটা এলোমেলো হয়েছে–কিন্তু আমারতো কিছু হয়নি। আমি ড্রাগও ধরিনি, মাথা খারাপের মত আচরণও করছি না।
হোসেন সাহেব ধরা গলায় বললেন, তুইও করছিস। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল, দাওয়াতের চিঠি চলে গেল তখন তুই সব বাতিল করে দিলি। এটাতো মা এক ধরনের অসুস্থতা।
নীতু বাবার হাতে হাত রেখে বলল, বাবা এরকম আর হবে না। তুমি আবার আমার জন্যে একটা বিয়ে ঠিক কর, দেখবে আমি হাসি মুখে বিয়ের আসরে গিয়ে বসব।
হোসেন সাহেব বললেন, আমার নিজের শরীরটা ভাল না। কয়েকদিন পরপর বুকে ব্যথা হয়, তোদের বলি না। তোরা নাভাস হয়ে পড়বি। আমি বুঝতে পারছি আমার সময় শেষ হয়ে গেছে। অথচ কিছুই গুছিয়ে যেতে পারলাম না। সব এলোমেলো। যত দিন যাচ্ছে ততই এলোমেলো হচ্ছে।
নীতু বলল, দুধটা খাও বাবা।
হোসেন সাহেব বাধ্য ছেলের মত দুধের গ্লাসে চুমুক দিলেন। বাবাকে দেখে নীতুর মনটা মায়ায় ভরে গেল। তার ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে এমন কিছু করে যা দেখে তার বাবার মনটা ভাল হয়ে যায়। তিনি যেন বুঝতে পারেন তাঁর সংসারটা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায় নি।
নীতু বাবাকে ঘুমুতে পাঠিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে প্যাডের কাগজে লিখল,
আতাহার ভাই,
দয়া করে আপনি কি এক্ষুণি একটু আসবেন?
ইতি নীতু
নীতু চিঠি খামে বন্ধ করল না। চিঠিতে এমন কিছু লেখা নেই যে খামের ভেতর আড়াল করে পাঠাতে হবে। খুব সহজ সরল আহ্বান।
নীতু চিঠি হাতে ড্রাইভারের খোঁজে গেল। ড্রাইভারকে বলে দিল চিঠিটা যেন সে আতাহারকে দেয় শ্রবং যত রাতই হোক সে যেন আতাহারকে নিয়ে আসে। রাত তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলেও সে যেন অপেক্ষা করে।
নীতু বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছে। যত রােতই হোক সে অপেক্ষা করবে। আতাহার যদি রাত তিনটাতেও আসে সে বসেই থাকবে। দেরীতে এলেই ভাল হয়, আতাহার ভাইকে কি বলবে তা সে গুছিয়ে নিতে পারবে। বেশি কিছু বলবে না। অল্প কয়েকটা কথা–আতাহার ভাই আমি সারাক্ষণ আপনার কথা ভাবি। আমি জানি আমার ভয়ংকর কোন অসুখ করেছে। আপনি আমার অসুখ সারিয়ে দিন।
তার মুখে এই ধরনের অদ্ভুত কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে তাকবেন তখন সে আতাহার ভাইয়ের হাত ধরে যা মনে আসে তাই বলবে। আগে থেকে কিছু ভেবে
করলেও করবে। তাকে যদি সবাই পৃথিবীর সবচে। খারাপ মেয়ে ভাবে তাতেও কিছু যায় আসে না। কিছু যায় আসে না। কিছু যায় আসে না। না–না-না।
নীতু বারান্দার বাতি নিভিয়ে রাখল। অন্ধকারই ভাল। অন্ধকারে এমন অনেক কিছু বলা যায় যা আলোতে বলা যায় না। শুধু একটাই সমস্যা অন্ধকারে সে আতাহার ভাইয়ের মুখটা দেখতে পাবে না। মুখ না দেখতে পেলেও ক্ষতি নেই–সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবে। আজ রাতের জন্য সে হবে এক অন্ধ তরুণী।
ড্রাইভার রাত একটার দিকে ফিরে এসে জানালো–আতাহারকে সে খুঁজে পায়নি। সে আগে যেখানে থাকতো সেখানে নেই। এখন অন্য কোথায় যেন থাকে। কেউ বলতে পারে না কোথায়।
কি অপূর্ব পংক্তিমালা
আতাহার কাল রাত থেকে পথে পথে ঘুরছে। নিজের ঘরে ফেরে নি। ফরহাদকে প্লেনে তুলে দিয়ে তার মনটা এত খারাপ হল যে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করল না। মনে প্ৰচণ্ড কষ্ট নিয়ে কেউ ঘরে ফিরে না। সন্ধ্যাবেলা সব পাখি ঘরে ফিরে। কারণ পাখিদের মনে কষ্ট নেই। মানুষের মনে নানান ধরনের কষ্ট। তাই বুঝি সব মানুষ ঘরে ফেরে না।
ফরহাদ এয়ারপোর্টে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল। তার গায়ে কমপ্লিট স্যুট। গলায় লালের উপর কাল ফুলের টাই। পায়ে চকচকে নতুন জুতা। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
ফরহাদ বলল, একা একা আমেরিকা যেতে ভয় লাগছে।
ভয়ের কি আছেরে গাধা। নিউ ইয়র্কে নামবি। আপা এয়ারপোর্ট থেকে তোকে নিয়ে যাবে।
যদি না আসে?
আসবে না কেন? আসবেতো বটেই, না এলে এয়ারপোর্টে নেমে টেলিফোন করে দিবি।
ভাইয়া, তুমি আমেরিকা যাবে না?
যাব, তুষারপাত দেখার জন্যে বেড়াতে যাব। দেশ ছেড়ে যাব না। আমি হচ্ছি এই দেশের একজন কবি। কবিরা দেশের আত্মা! দেশ ছেড়ে আত্মা যাবে কি ভাবে? আমি কি করে যাই।
তুমি সারা জীবন পথে পথে ঘুরবে? এর বাড়িতে খাবে, ওর বাড়িতে ঘুমাবে।
তা না। কিছু দিনের মধ্য একটা চাকরি জোগার করব। তারপর যথা সময়ে বিয়ে টিয়ে করে গৃহপালিত হয়ে যাব।
তোমাকে চাকরি কে দেবে?
ময়না ভাই। খুব ওস্তাদ লোক–অনেক কানেকশন। তার সঙ্গে মোটামুটি কথাও হয়েছে। উনি চাকরির ব্যবস্থা করলেই শুভ বিবাহ। তোকে কার্ড পাঠিয়ে দেব। চলে আসবি।
কাকে বিয়ে করবে?
এখনো ঠিক করিনি। খুব সম্ভব নীতুকে। সমস্যা একটাই, মেয়েটা আমাকে দু চোখে দেখতে পারে না।
দু চোখে দেখতে পারে না এমন একটা মেয়েকে তোমার বিয়ে করার দরকার কি?
এখন দেখতে পারে না–তবে আমার ধারণা আমার সঙ্গে ভালমত মিশলে আমাকে সে পছন্দই করবে। মানুষ হিসেবে আমি কি খারাপ?