ইতি মনিকা
মতির মা!
জ্বি।
আতাহার আমাকে দেখতে আসে না?
ও আল্লা, আসে না আবার! এক-দুইদিন পরে পরেই আসে। ভাইজান যখন আসে তখন আফনে থাকেন ঘুমে।
মতির মার এই কথাগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আতাহার গত এক মাসে দুবার মাত্র এসেছিল। রোগীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখার জন্যে মিথ্যা বলতে হয়। এতে দোষ হয় না।
আতাহার আছে কেমন?
ভালই আছে আম্মা। আপনার অবস্থা দেইখ্যা খুব পেরেশান।
দুশ্চিন্তা করছে খুব?
দুশ্চিন্তা বলে দুশ্চিন্তা। ভাইজানের বলতে গেলে ঘুম হারাম।
অসুখ-বিসুখে সে সব সময় অস্থির হয়।
ভাইজান দাড়ি রাখছে গো আম্মা।
দাড়ি রাখছে কেন?
ওখন ভাইজানরে আরো সুন্দর লাগে।
সালমা বানুরাগী গলায় বললেন, সুন্দর লাগলেও হুট করে দাড়ি রাখবে কেন? আমাকে আরেকটু পানি দাও তো মতির মা।
মতির মা পানি এনে দিল। এক চুমুক খেয়েই তিনি গ্লাস ফেরত দিলেন। পানি আরো তিতা লাগছে। মনে হচ্ছে পানিতে নিমপাতার রস হালকা করে মিশিয়ে দিয়েছে।
মতির মা!?
জ্বি আম্মা।
তোমার খালুজান আছেন কেমন?
ভাল আছেন আম্মা।
তাঁর বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে।
কষ্ট তো আম্মা হইবই।
উনার বয়স হয়েছে তো। এই বয়সে শরীর সেবা-যত্ন চায়। উনার দেখাশোনার কেউ নাই।
ছোট আফা আছে। ছোট আফার সবদিকে খুব নজর।
নজর হলেও সে নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। তা ছাড়া বাবার ভয়ে সব সময় অস্থির। কাউকে ভয় পেলে তার সেবা-যত্ন করা যায় না।
তাও ঠিক?
তোমার খালুজান মাঝে মাঝে রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে ঘুম থেকে উঠে আমাকে ডেকে তুলে বলে বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা করে এক গ্লাস লেবুর সরবত দাও। লেবুর সরবতের কি যে এক নেশা! মেয়েকে সে তো আর রাত তিনটার সময় লেবুর সরবতের জন্যে ডেকে তুলবে না। তাই না?
ঠিক আম্মা।
বিয়ের রাতেও তোমার খালুজানের লেবুর সরবত খাওয়ার ইচ্ছা হল। রাত তিনটা সাড়ে তিনটা বাজে। আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি। তোমার খালুজান গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। তোমার খালুজান বললেন–শরীরটা ভাল লাগছে না। এক গ্লাস লেবুর সরবত খাওয়াবে? চিন্তা কর অবস্থা! আমি নতুন বৌ। ঐ বাড়ির কাউকে চিনি না। কাকে গিয়ে লেবুর সরবতের কথা বলব? দরজা খুলে বাইরে এসেছি। তোমার খালুজানের বড়বোনের সঙ্গে দেখা। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে উনাকে লেবুর সরবতের কথা বললাম। উনি হাসতে হাসতে আমাকে বললেন–লেবুর সরবতটরবত কিছু না। তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে এইসব ফন্দি করছে। কি যে লজ্জার মধ্যে পড়েছিলাম মতির মা!
লজ্জারই কথা।
তোমার খালুজানের বড়বোন আমাকে খুবই আদর করতেন। এই যে অসুখ হয়ে পড়ে আছি, উনি বেঁচে থাকলে দিনরাত আমার পাশে থাকতেন। তার মত ভাল মহিলা আমি আমার জীবনে দেখিনি মতির মা। টাইফয়েডে মারা গিয়েছিলেন। খুব সুন্দর মৃত্যু হয়েছিল উনার। অসুখের খবর পেয়ে চিটাগাং-এ তাকে দেখতে গিয়েছি–আমাকে দেখে কি খুশি। হাসতে হাসতে বললেন, বৌ আসছে, বৌ আসছে। আমাকে বৌ ডাকতেন।
আম্মা, আফনে একটু ঘুমানের চেষ্টা করেন।
ঘুম আসছে না মতির মা। তারপর শোন কি হয়েছে–সন্ধ্যার সময় উনার পাশে বসেছি। মাথায় বিলি দিয়ে দিচ্ছি। উনি বললেন, বৌ, কাকে কি বলতে হবে আমাকে বলে দাও। আমি বললাম, আপনার কথা বুঝতে পারছি না। উনি হাসিমুখে বললেন, তোমার মৃত আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে তো খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে–ওদের কি বলতে হবে বলে দাও। এই বলেই খুব হাসতে লাগলেন। উনি খুব রসিক ছিলেন। মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগে রসিকতা করা তো খুব সহজ ব্যাপার না। তাই না মতির মা?
জ্বি।
মতির মা! পানি খাব।
মতির মা পানির গ্লাস এনে দিল। তিনি আবারো এক চুমুক পানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিলেন। দীর্ঘ সময় কথা বলে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে লাগলেন।
কোথায় যেন কাচ কাচ শব্দ হচ্ছে।
কচকচ শব্দে কেউ কিছু খাচ্ছে। সালমা বানু চোখ মেললেন। অপরিচিত একটা ছেলে তাঁর মাথার কাছে বসে মহানন্দে আপেল খাচ্ছে। ছেলেটার মুখ ভর্তি ফিনফিনে দাড়ি। টকটকে ফর্স গায়ের রঙ। ছেলেটাকে খুবই চেনা লাগছে। তাকে তাকাতে দেখে ছেলেটা আপেল খাওয়া বন্ধ রেখে তার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, মা, তোমার আপেল সব খেয়ে ফেলছি।
সালমা বানুর বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগল। কি আশ্চর্য কাণ্ড, নিজের ছেলেকে তিনি চিনতে পারছেন না! মুখ ভৰ্তি দাড়ি রেখেছে তো কি হয়েছে? গায়ের গন্ধেই তো তাঁর চিনে ফেলা উচিত ছিল। ছোটবেলা থেকেই আতাহারের গায়ে বার্লি বালি গন্ধ।
সালমা বানু খুশি খুশি গলায় বললেন, বটু, তোকে চিনতে পারিনি।
আতাহার আপেলে বড় করে কামড় দিতে দিতে বলল, চিনতে না পারলে তোমার কোন দোষ নেই। আমি নিজেই নিজেকে চিনতে পারি না। যখনি আয়নায় নিজেকে দেখি তখনি মনে হয় অপরিচিত কাউকে দেখছি। তোমার অবস্থা তো মা খুবই খারাপ। দিনরাত না-কি ঝিম ধরে থাক?
সালমা বানু হাসলেন। ছেলেকে দেখে তার এত ভাল লাগছে! লম্বা-চওড়া ছেলে। জন্মের সময় এই এতটুক হয়েছিল। ডাক্তার বললেন, আন্ডারগ্রোথ চাইলন্ড। মাত্র ২.৯ পাউন্ড ওজন। সারভাইভ না করারই সম্ভাবনা। ছেলেকে নিয়ে প্রায় এক মাস থাকতে হয়েছে। হাসপাতালে। রাতের পর রাত তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে কাটিয়েছেন। সামান্য শব্দ হলেই ছেলে কেমন চমকে তাকাতো। মুঠি বন্ধ করে শরীর শক্ত করে ফেলত। কি দিন গিয়েছে! একবার তো হঠাৎ নিঃশ্বাস বন্ধ। হাত-পা সব নীল হয়ে গেল। ডাক্তার-নার্স সব ছোটাছুটি শুরু করে দিল। সালমা বানুর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি তাড়াতাড়ি ছেলেকে বাবার কোলে দিয়ে অজু করে জায়নামাজে গেলেন। ছেলের জীবন রক্ষার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন–হে পরোয়ার দেগার, আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না। ধন না, সম্পদ না, সুখ না, শান্তি না। আমি শুধু আমার ছেলের জীবন তোমার কাছে ভিক্ষা চাই। নামাজে দাঁড়িয়ে তার কাছে মনে হল শিশু যখন তার মার কোলে থাকে তখন আজরাইল তার জানি কবচ করতে পারে না। আজরাইলকে নিষেধ করা আছে সে যেন কোন মার কোল থেকে শিশুর জীবন ছিনিয়ে না নেয়। যে কারণে মার কোলে থাকা অবস্থায় কখনো কোন শিশুর মৃত্যু হয় না। মা যখন মনের ভুলে বা অন্য কোন কারণে তাঁর অসুস্থ শিশুকে অন্যের কাছে ক্ষণিকের জন্যে দেন সেই সময় টুক করে আজরাইল তার জান নিয়ে ছুটে চলে যায়। এই কথা মনে হওয়ামাত্ৰ সালমা বানু নামাজ ছেড়ে ছেলের কাছে ছুটে গেলেন। ছেলের বাবার কাছ থেকে ছেলেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে নিলেন।