সাজ্জাদ মেয়ের ঘরে ঢুকল। মেয়ের দিকে তাকাল না। তাকাতে ইচ্ছা করছে না। নাতাশা বলল, তুমি এত রেগে আছ কেন বাবা?
রাগি নাই।
ধমকাধমকি করছ।
আরে বক বক করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।
এতদিন পরে এসেছ, বেচারার তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে।
সাজ্জাদ তিক্ত গলায় বলল, তোর এত বড় অসুখ আমি জানলাম না কেন? আমার জানতে অসুবিধাটা কোথায় ছিল?
এই নিয়ে তুমি মার সঙ্গে ঝগড়া করবে?
ঝগড়া করব না। আমি শুধু জানতে চাইব। জানার অধিকার আমার নিশ্চয়ই আছে।
তুমি তো দেখি আমার সঙ্গেই ঝগড়া শুরু করে দিলে। বাবা, আমার কথা শোন বাথরুমে গিয়ে ভালো করে গোসল কর। তারপর গরম এক কাপ চা খাও। এরমধ্যে মা এসে পড়বে। ঝগড়া যে এক্ষুনি করতে হবে তা তো না। কয়েকদিন পরেও করতে পারবে। মা খুব কষ্টের মধ্যে আছে বাবা। সারাদিন ছোটাছুটি করে। টাকার জোগাড় হচ্ছে না। এদিকে যাবার সব ঠিকঠাক। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে মা আসবে, আর আসামাত্র তুমি একটা ঝগড়া শুরু করবে, সেটা কি ভালো হবে?
আমার ভালো-মন্দ তোকে দেখতে হবে না।
যে কদিন আমি বেঁচে থাকব সেই কদিন আমিই দেখব। তুমি না চাইলেও দেখব। বাবা, গোসল করতে যাও। আমি বুয়াকে বলছি চা বানানোর জন্যে। তুমি বাথরুম থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে চা দেবে। গোসলের পর চায়ে চুমুক দেবার পর দেখবে তোমার রাগ অনেকটা কমে গেছে।
সাজ্জাদ বাথরুমে ঢুকল। গোসল সেরে চা খেয়ে মেয়ের পাশে বসল। নাতাশা খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প করে যাচ্ছে। সাজ্জাদ শুনছে। আবার ঠিক শুনছেও না। সে আছে একধরনের ঘোরের মধ্যে, যে ঘোর কখনো কাটবে না। রাত দশটার উপর বাজে। দিলশাদ এখনো ফিরছে না। সাজ্জাদ বলল, তোর মা কি রোজই এমন দেরি করে?
এখন প্রায়ই করে। তোমার খিদে লেগেছে, তুমি কি খেয়ে নেবে?
তুই কখন খাবি?
একটু পরেই খাব। বাবা, তোমার রাগটা কি কিছু কমেছে?
সামান্য কমেছে।
আরো একটু কমাও।
আচ্ছা যা, কমাব। তোর মা’র এত দেরি করে ফেরার কারণ তো বুঝতে পারছি না। ঢাকার রাস্তাঘাটও তো সুবিধার না।
তুমি চিন্তা করো না বাবা, মা এসে পড়বে। তুমি বরং ভাত খেয়ে নাও। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার খুব খিদে পেয়েছে।
রাত দশটার পর তো কোথাও কোনো ডাক্তার থাকার কথাও না।
আজ মা’র মেজোখালার বাসায় যাবার কথা। ডাক্তারের কাছ থেকে হয়তো সেখানে গেছেন। মেজোখালু সাহেবের আজ মাকে কিছু টাকা দেয়ার কথা।
নাতাশা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মা টাকা চেয়ে চেয়ে ঘুরছে। কী খারাপ যে তাঁর লাগছে কে জানে!
.
দিলশাদ তার মেজোবোন দিলরুবার বাসায় রাত আটটা থেকে বসে আছে। স্বামী স্ত্রীর দুজনের কেউই ফ্ল্যাটে নেই। উত্তরায় তাদের বাড়ি হচ্ছে, সেই বাড়ি দেখতে গেছে। কাজের মেয়ে বলল, আইস্যা পড়ব। এক্ষণ আসব।
কাজের দুটি মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। দিলরুবার একটিই মেয়ে, সে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করে। ছুটি-ছাটায় আসে। এখন গরমের ছুটি চলছে সে আসে নি। শান্তিনিকেতন থেকে একটা দল যাচ্ছে মালয়েশিয়ায়। সে তাদের সঙ্গে যাবে।
দিলরুবাদের ফ্ল্যাট ছবির মতো সুন্দর। হালকা গোলাপির কম্বিনেশন। কার্পেট গোলাপি, সোফার কাপড় গোলাপি, জানালার পর্দাও গোলাপি। দেয়ালে কিছু পেইন্টিং আছে। মনে হয় অর্ডার দিয়ে আঁকানো, কারণ পেইন্টিং-এও গোলাপি রঙের আধিক্য। গোলাপি রঙটা দিলশাদের অপছন্দ, কিন্তু এই ঘরে রঙটা এত মানিয়েছে। সবচে সুন্দর লাগছে গাঢ় গোলাপি ভেলভেটের সোফাসেট। সমস্যা একটাই- গা এলিয়ে আরাম করে বসতে অস্বস্তি লাগে। মনে হয় ভেলভেট ব্যথা পাবে। দিলশাদ অবশ্যি গা ছেড়েই শুয়ে আছে। এত ক্লান্ত লাগছে, মনে হয় সে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়বে। কাজের মেয়েটি বলল, চা দিব আফা?
দিলশাদ বলল, চা না, যদি পার লেবুর সরবত বানিয়ে দাও। ঘরে লেবু আছে?
আছে। আফা সেন্ডেল খুইল্যা বসেন। নতুন কার্পেট কিনছে। কেউ স্যান্ডেল লইয়া উঠলে আম্মা মনে মনে বেজার হয়।
দিলশাদ স্যান্ডেল খুলতে খুলতে বলল, এত সুন্দর জিনিস নষ্ট হলে মন খারাপ তো হবেই।
একটুকরা মোড়া কাপড়। দাম হইল ত্রিশ হাজার টেকা। শুনলেই বুক কাঁপে।
তাহলে তো শুধু স্যান্ডেল খুলে সোফায় উঠলে হবে না, অজু করে উঠতে হবে।
কাজের মেয়েটা সরু চোখে দিলশাদকে দেখছে। এই মেয়েটি কি সাজ্জাদের ঘড়ি চুরির খবর দিয়েছিল? যদি সে হয় তাহলে দিলশাদের দিকেও সে লক্ষ রাখবে। চলে যাবার সময় দিলশাদ কি বলবে– বুয়া, দেখে নাও তোমাদের জিনিস সব ঠিকঠাক আছে কি-না।
.
দিলরুবা বাড়িতে ঢুকল রাত দশটায়। ছোটবোনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ওমা, তুই! কখন এসেছিস?
নটা থেকে বসে আছি। তুমি একা যে, দুলাভাই কোথায়?
আজ ছাদ ঢালাই হচ্ছে। ও থাকবে। রাত একটা-দেড়টার আগে ফিরবে না। আমাকেও থাকতে বলেছিল। ভাগ্যিস থাকি নি। থেকে গেলে তোর সঙ্গে দেখা হতো না। তুই আসবি জানলে ওকেও নিয়ে আসতাম।
আজ যে আসব সেটা তো দুলাভাইকে টেলিফোন করে বলেছিলাম।
ওর আজকাল কিছু মনে থাকে নাকি? ও যে নিজের নাম মনে রাখে সে-ই যথেষ্ট।
কেন?
বুঝলি দিলু, ব্রেইন ডিফেক্টের মতো হয়ে গেছে। ব্যবসার অবস্থা ভয়াবহ। বড় অ্যামাউন্টের একটা এলসি খুলেছিল। ব্যাংক থেকে কী যেন প্রবলেম করছে। আমি জানিও না, কিছু বুঝিও না। গতকাল আমাকে বলে, রুবা, আমাকে একলাখ টাকা ধার দাও না। তিনশ বস্তা সিমেন্ট কিনব। অবস্থা চিন্তা কর। আমি টাকা পাব কোথায়? শেষে বলে, তোমার গয়না বিক্রি কর। ভাবটা এরকম যেন আমার লাখ লাখ টাকার গয়না আছে। ওর বন্ধুবান্ধব এখন ওকে দেখলে পালিয়ে বেড়ায়। সবাই ভাবে, বোধহয় এক্ষুনি টাকা ধার চাইবে…।