টিং টিং টিটিং টিং
রেবা রেবা লিং লিং
আমার এইসব গোপন ইচ্ছার কথাও আমি আমার ডায়েরিতে লিখি। আগে খুব হেলাফেলা করে ডায়েরি লিখতাম। আসলে জানতাম না তো কী করে ডায়েরি লিখতে হয়। একদিন লিখলাম–
আজ লবণের বাটিতে একটা মরা তেলাপোকা পাওয়া গেল। মা ফুলির মাকে খুব বকা দিলেন। ফুলির মা বলল, আমি কি তেল্যাচুরারে কইছিলাম লবণের বাটিত গিয়া মরতে? আমারে বকেন ক্যান? ফুলির মা’র কথা শুনে মা খুব রেগে গেল। মা বললেন, তোমাকে দিয়ে আমার পুষাবে না। তুমি অন্য কোথাও কাজ দেখ। ফুলির মা বলল, জে আইচ্ছা। যে কাম জানে তার কামের অভাব হয় না। ফুলির মাকে চলে যেতে বললে সে সবসময় বলবে– জে আচ্ছা। কিন্তু কখনো যাবে না।
আরেকদিন লিখলাম–
আজ পটল দিয়ে মাছ রান্না করা হয়েছে। বোয়াল মাছ আর পটল। বাবা বললেন, বোয়াল নিম্নশ্রেণীর মাছ। পটল উচ্চ শ্রেণীর তরকারি। পটল দিয়ে বোয়াল মাছ রান্না ঠিক হয় নি। ভুল হয়েছে। এতে তরকারি হিসেবে পটলকে অপমান করা হয়েছে। এই নিয়ে মা এবং বাবার মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া বেঁধে গেল।
এইসব আজেবাজে কথা লিখে শুধু শুধু পাতা ভরানো। কোনো মানে হয় না। আসলে আমাদের জীবনটা এরকম যে লেখার মতো কিছু ঘটে না। স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে এসে ভাত খাওয়া, রাতে পড়াশোনা করে ঘুমুতে যাওয়া- ব্যস, এইটুকুতেই সব।
আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়ে মেয়েটার উপর আমার খুব ঈর্ষা হলো। কত ভাগ্যবতী মেয়ে! তার ছোট্ট জীবনে কত কিছু ঘটেছে। আর কী সুন্দর করে গুছিয়েই
সে সবকিছু লিখে গেছে। আমার যদি এরকম ঘটনার জীবন হতো আমিও সুন্দর করে সব লিখে রাখতাম। আনা ফ্রাঙ্কের মতো চিঠির আকারে ডায়েরি। সে তার কল্পনার বান্ধবীকে উদ্দেশ করে চিঠির মতো লিখেছে। আমি লিখতাম বাবাকে উদ্দেশ করে। মাকে উদ্দেশ করেও লেখা যায়। তবে মাকে লিখতে ইচ্ছে করে না। মাকে সবসময় আমার নিজেরই একটা অংশ বলে মনে হয়। তাঁর কাছে চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে না।
আনার মতো ডায়েরি আমি লেখার চেষ্টা করছি অসুখের পর থেকে। প্রথম দিনই বেশ বড় করে লিখলাম। এখন খুব ছোট ছোট করে লিখছি। কারণ হচ্ছে আমি চোখে ঝাঁপসা দেখছি। মাকে চোখের এই ব্যাপারটা বলা হয় নি। এমনিতেই তিনি চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। সেই চিন্তা বাড়িয়ে কী হবে! আমি যদি এখন বলি– মা, আমি চোখে ঝাঁপসা দেখতে শুরু করেছি, তাহলে মা কী করবে? তার কিছুই করার নেই। শুধু শুধু অস্থির হবে আর ভয়ঙ্কর কষ্ট পাবে। এমনিতেই বেচারি কষ্টে মরে যাচ্ছে। সেই কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী?
বাবাকে উদ্দেশ করে লেখা প্রথম ডায়েরির লেখাটা এরকম (খুব চেষ্টা করেছি আনা ফ্রাঙ্কের মতো হাসি-খুশিভাবে লিখতে। হয় নি।)
বাবা,
আজ আমার একটা অসুখ ধরা পড়েছে। অসুখটার নাম মেনিনজিওমা। এরকম অদ্ভুত নাম তুমি নিশ্চয়ই এর আগে শুন নি। কেউই বোধহয় শুনে নি। যাকেই এই নাম বলা হবে সে-ই ভুরু কুঁচকে বলবে, অসুখটা কী?
অসুখটা ভয়াবহ। কতটা যে ভয়াবহ তা আমি মাকে দেখে বুঝতে পারি। আমার অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে মাকে দেখাচ্ছে অবিকল মরা মানুষের মতো। তোমার মনে আছে, দাদিজানের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাকে আমরা দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি পুরনো কালো খাটটায় তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার মুখ হলুদ রঙের একটা চাঁদরে ঢাকা। সাধারণত মৃতদেহ সাদা চাঁদরে ঢাকা থাকে। দাদিজানকে হলুদ চাঁদরে কেন ঢাকল কে জানে! বোধহয় ঘরে কোনো সাদা চাঁদর ছিল না। আমরা দাদিজানের খাটের পাশে দাঁড়ালাম। কে একজন তার মুখ থেকে চাঁদর সরিয়ে দিল। আমি আঁৎকে উঠলাম। প্রাণহীন মানুষের মুখ এত ভয়ঙ্কর!
মায়ের মুখও প্রাণহীন মানুষদের মুখের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে। তিনি অবশ্যি খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন, যেন আমি কিছু বুঝতে না পারি। যেদিন আমার অসুখটা মা প্রথম জানলেন সেদিন বাসায় ফিরেই ফুলির মাকে বললেন, বুয়া, চা কর। নাতাশাকেও এক কাপ দিও।
ফুলির মা হতভম্ব গলায় বলল, আফনের হইছে কী?
কিছু হয় নি। হবে আবার কী? টায়ার্ড।
সন্ধ্যার পর অতিরিক্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন, অনেকদিন টিভি দেখা হয় না। আজ টিভি দেখব। ইন্টারেস্টিং কিছু কি আজ টিভিতে আছে?
সে-রাতে অতি কুৎসিত একটা নাটক হলো। একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। তাকে না পেলে সে পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু তাকে সে বিয়ে করবে না, কারণ বিয়ে করলে তার ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যাবে। কী যে জগাখিচুড়ি! বড় বড় সব কথা। একটু পর পর কবিতা আবৃত্তি। নায়ক এক একবার কাঁপা কাঁপা গলায় কবিতা শুরু করে আর আমার ইচ্ছা করে দেই কষে একটা চড়।
মা সেই নাটকও চোখ বড় বড় করে দেখল এবং নাটক শেষ হলে বলল, মন্দ না তো। রাতে মা আমার সঙ্গে ঘুমুতে এলো। সে-রাতে খুব গরম পড়েছিল। তার উপর ছিল না ইলেকট্রিসিটি। কিছুতেই আমার ঘুম আসছে না। মা বোধহয় মানসিকভাবে খুব ক্লান্ত ছিল। শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। আমি জেগে আছি। এপাশ-ওপাশ করছি। তখন হঠাৎ মনে হলো– মানুষের যেমন ‘অসুখ’ হয় সেরকম ‘সুখ’ হবার নিয়ম থাকলে খুব ভালো হতো। পৃথিবীতে নানান ধরনের অসুখের মতো নানান ধরনের সুখ থাকত। ছোট সুখ, বড় সুখ। একেক সুখের একেক নাম। কোনো মা’র মেয়ের বড় ধরনের সুখ হলে সেই মা আনন্দে অস্থির হয়ে চারদিকে টেলিফোন করে খবর দিত– আমার মেয়ের না এই সুখ হয়েছে।