হুঁ। ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বললাম।
কোন মেয়ে?
নীলু। মেয়েটাকে তো ভালোই মনে হল।
আপনার পছন্দ হয়েছে? পাশ করেছে পরীক্ষায়?
হাইট অবশ্যি কম, পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির মতো হবে। কী বলিস?
হতে পারে। মেপে দেখি নি কখনো।
দুই ইঞ্চি হিল পরলে ধরা যাবে না।
হুঁ।
মেয়েটার আঙুলগুলি একটু মোটা। ওয়ার্কিং ক্লাসের মেয়েদের মতো।
তাই নাকি, আমি লক্ষ করি নি।
বড়োফুফু বললেন, সব মিলিয়ো তো পাওয়া যায় না। এই মেয়েটির একটা অবশ্যই ভালো দিক আছে, ছোট ফ্যামিলির মেয়ে, মাথা নিচু করে থাকবে সব সময়। শব্দটাও করবে না। কী বলিস, ঠিক না?
অন্য রকমও হতে পারে। হয়তো ফোঁস করে উঠবে।
হুঁ।
গরিব আত্মীয়-স্বজনরা রাতদিন ভিড় করবে। স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল পায়ে দিয়ে পাকা কাঁঠাল হাতে আপনার ড্রইগুরুমে এসে বসে থাকবে। পান খেয়ে এ্যাশট্রেতে পিক ফেলবে। নাক ঝাড়বে।
বড়োফুফু দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, মেয়েটির বাবা কী করে?
জানি না কী করে।
সে কি! তোদের ভাড়াটে, আর তোরা জানিস না কী করে?
ভাড়াটে-ফাড়াটে বোধ হয় না। দাদা থাকতে দিয়েছিলেন, চক্ষুলজ্জায় পড়ে মাসে মাসে কিছু দিত।
বাড়ি কোথায়?
কে জানে কোথায়?
বাড়ি কোথায় সেটাও জানিস না?
উঁহু।
আমি মেয়েটিকে আমার মগবাজারের বাসায় যেতে বলেছি। বেড়াবার জন্যে।
আপনার তাহলে ভালোই পছন্দ হয়েছে।
বাড়ি কোথায়, সেটা না জেনে বেড়াতে যাবার কথা বলা ঠিক হয় নি।
একটি মেয়ে ভালো কি মন্দ, তার সাথে তার বাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই।
আমার সাথে বাজে তর্ক করিস না। বাজে তর্ক জীবনে অনেক শুনেছি। তোর কাছ থেকে না শুনলেও চলবে।
বড়োফুফু টেলিফোন নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এবার বোধহয় লাইন পাওয়া গেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমি শুনলাম, বড়োফুফু, চেঁচাচ্ছেন, ঘুমিয়ে পড়েছিলি? ফাজলামির জায়গা পাস না। ছোটলোক কোথাকার। এক চড় দিয়ে…
চা আনতে গিয়ে কোথায় উধাও হলি?
চায়ের কথা আমার মনেই ছিল না। রাত জেগে শরীর খারাপ লাগছে। এসেছিলাম অন্ধকারে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব ভেবে। বাবুভাই নিজেও দেখলাম শুয়ে আছে। গায়ে পাতলা একটা চাদর। বাবুভাই ক্লান্ত স্বরে ব্রলাল, একটু যেন জ্বর জ্বর লাগছে রে।
বাবুভাই, তুমি উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিচে যাও।
নাহ।
না কেন?
কেউ মারা যাচ্ছে, এটা দেখতে ভালো লাগে না। অনেক বার দেখেছি।
আমি চুপ করে রইলাম। বাবুভাই নিচু গলায় বলল, মুখে আমরা অসংখ্য বার বলি মরতে তো হবেই, কিন্তু সত্যি সত্যি মৃত্যু যখন আসে তখন মনটন ভেঙে যায়।
বাবুভাই চাদর গায়ে উঠে বসল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমাদের হাতে এক বার বেলুচ রেজিমেন্টের এক নন-কমিশও অফিসার ধরা পড়ে গেল। হাবিলদার মেজর। ব্যাটাকে আমরা এগার মাইল হাঁটিয়ে মেথিকান্দা নিয়ে এলাম। ব্যাটার মনে কোনো ভয়ডর নেই। সিগারেট দিই। ভূসভূস করে টানে। চা দিয়েছি, শেষ করে আরেক কাপ চাইল। ব্যাটার সাহসের তারিফ করি মনে মনে।
নাম কী ছিল?
নাম মনে নেই। নাম দিয়ে দরকার কি?
এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
নাম বাহাদুর খাঁ। ঝিলামের এক গাঁয়ে বাড়ি। দুই ছেলে ছিল–এক জন মটর মেকানিক, অন্য জন নেভিতে।
ও।
এইসব আমি মনে করতে চাই না। নামধাম দিয়ে কী হয়?
আমি সিগারেট ধরলাম। ক্ষুধা বোধ হচ্ছে ক্ষুধার সময় সিগারেট ভালো লাগে না। বমি-বমি লাগে। বাবুভাই বলল, মেথিকান্দা পৌঁছেই শুনি নতুন করে মিলিটারি রিইনফোর্সমেন্ট আসছে। আমাদের এক্ষুণি পালাতে হবে। ঠিক করা হল, বাহাদুর খাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে না।
মেরে ফেলা হবে?
হুঁ।
তারপর?
ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর এত বড়ো একটা সাহসী মানুষ ছরছর করে পেচ্ছাপ করে ফেলল, কথা জড়িয়ে গেল। উল্টা-পাল্টা কথা বলতে লাগল।
তারপর?
এর আবার তারপর কি?
বাবুভাই হঠাৎ রেগে গেল। তার সম্ভবত নেশা হয়েছে।
আমাদের অভ্যেসই হচ্ছে একটা তারপর খোঁজা। মৃত্যুর আবার তারপর কি?
আমি জবাব দিলাম না। বাবুভাই সিগারেটে টান দিয়ে খকখিক করে খুব কাশতে লাগল। কাশি থামলে কড়া গলায় বলল, আমি মরবার সময় এক জন সাহসী মানুষের মতো মরব।
লাভ কি তাতে?
লাভ-লোকসান জানি না। সব কিছুতে লাভ-লোকসান খোজা মানুষের আরেকটি অভ্যাস। বাজে অভ্যাস।
তুমি শুধু শুধু রাগছ, বাবুভাই।
শুধু শুধু রাগছি?
হুঁ।
টগর দেখ, তোকে আমি একটি কথা বলে রাখি–মারবার সময় আমি এক জন সত্যিকার সাহসী মানুষের মতো মরব। আরো এক জন বড়ো ডাক্তার আন, এই বলে হৈ-চৈ শুরু করব না।
ভালো কথা। শুনে খুশি হলাম।
দরজার পাশে খুঁট করে শব্দ হল। বাবুভাই অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কে? কে?
আমি, আমি শাহানা। অন্ধকারে কী করছ?
কিছু করছি না। তুমি কী চাও?
ভেতরে আসব?
না।
শাহনা চাপা স্বরে বলল, ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন?
তাতে কারো তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
শাহানা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নানার জ্ঞান হয়েছে, তোমাকে খুঁজছে।
ঠিক আছে, যাব।
শাহানা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে গেলে ভালো হয়।
শাহানা নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। বাবুভাই অস্পষ্ট স্বরে বলল, বেশ তেজী মেয়ে। ঠিক না?
হুঁ।
এক জন মেয়ে-মানুষের মধ্যে এরকম তেজ দেখা যায় না।
হুঁ।
বাবুভাই বিছানা থেকে নামল। ক্লান্তস্বরে বলল, শরীর খারাপ লাগছে। গলায় আঙুল দিয়ে বমি করব।
যা করবার তাড়াতাড়ি কর, দাদা তোমাকে ডাকছে।
তোকে আরেকটা কথা বলতে চাই। বেশ জরুরী।